“ব্যানার্জি নয় মুখার্জী নয় চ্যাটার্জি নয় গ্যাঙ্গার্জী......নাম আমার কিশোরকুমার গাঙ্গুলী”, কিশোরকুমারের গাওয়া এই জনপ্রিয় গানটি শুনেছেন নিশ্চয়ই? কিন্তু ভেবে দেখেছেন এই পদবী গুলি কোথা থেকে এসেছে?
সোস্যাল কালচারাল অ্যান্থ্রোপলজি বা সামাজিক নৃতত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের ব্রাহ্মণদের সাথে মিল নেই। বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ সমাজের অধিকাংশই আর্য নন।মহাভারতে পূর্বভারতের অধিবাসীদের ম্লেচ্ছ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বৌধায়নের ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে বঙ্গদেশে প্রবেশ অপরাধ তুল্য এবং সেই অপরাধের নিমিত্তে প্রায়শ্চিত্তের উপায়ও বলে দেওয়া হয়েছে এই ধর্মশাস্ত্রে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে এই শাস্ত্রগুলি প্রণয়নের সময় থেকেই বঙ্গদেশ, ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ সমাজের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে, আদিমধ্য যুগে বাংলায় তাদের আগমন ঘটে কিন্তু হওয়ার সময় তাদের অনেকেই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং হিন্দু সমাজে পতিত রূপে গণ্য হতে থাকেন। পরবর্তীতে সেনযুগে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থান ঘটে। এই সময় আদিশূর নামক একজন কাল্পনিক চরিত্রের ব্যবহার করে বাংলার ব্রাহ্মণেরা সমাজে নিজেদের স্থান উঁচু জায়গায় নিয়ে যান এবং ক্রমে ক্রমে বৈদিক, রাঢ়ী, বারেন্দ্রী, কুলীন ও ভঙ্গ ইত্যাদি হরেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যান।
স্থানীয় কাহিনী অনুযায়ী বাংলায় আদিশূর নামের এক রাজা ছিলেন, তিনি কনৌজ রাজার কন্যা চন্দ্রমুখীকে বিবাহ করেন, বিবাহের পর চন্দ্রমুখী ঠিক করেন চন্দ্রায়ণ ব্রত করবেন কিন্তু পৌরোহিত্য করতে পারেন এমন কোনো ব্রাহ্মণের সন্ধান মিললো না, তখন শাণ্ডিল্য, কাশ্যপ, বাৎস্য, ভরদ্বাজ এবং সাবর্ণ গোত্রধারী পাঁচ সাগ্নিক ব্রাহ্মণকে আদিশূর বাংলায় নিয়ে আসেন। আর একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী কর্ণাট দেশ থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণ এসে সেনবংশীয় রাজাদের যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। ইতিহাসকারেরা জানান লক্ষণসেনের রাজসভায় ‘পঞ্চরত্ন’ নামক পাঁচ ব্রাহ্মণ সংস্কৃত কবি ছিলেন। সেনযুগের শাস্ত্রোপজীবি এবং কবিদের বেশিরভাগই ছিলেন জাতিতে ব্রাহ্মণ। সেনবংশের কিংবদন্তি শাসক বল্লালসেন বাংলায় কৌলীন্য প্রথা প্রচলন করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে বন্দ্যো অর্থাৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টো অর্থাৎ চট্টোপাধ্যায়, মুখোটি অর্থাৎ মুখোপাধ্যায় এবং গাঙ্গুলীরা বা গঙ্গোপাধ্যায় হলেন মুখ্য কুলীন। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ বলেছিলেন বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণদের গোত্র আছে কিন্তু গাঁই নেই, অর্থাৎ বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণদের পদবী গোত্রনাম থেকে প্রাপ্ত গ্রামের নাম থেকে নয়, যদিও এই যুক্তি সার্বিক সত্য নয় বলেই মনে করতেন অধ্যাপক সুকুমার সেন, তিনি জানান বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণ ভাদুড়ী পদবীটি ভদ্রবট গ্রামের নাম থেকেই প্রাপ্ত। তবে রাঢ়ি ব্রাহ্মণ অর্থাৎ চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি যে গোত্রনাম সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন অধ্যাপক সেন।
যে ব্রাহ্মণ চাটবৃত্তি করতেন অর্থাৎ পরিব্রাজকের জীবনযাপন করতেন তারাই হলেন চট্টোপাধ্যায়, এই চাটবৃত্তি শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে চাটতি রূপ নেয়, এই চাটুতি বা চট্টতির সাথে জী যুক্ত হয়ে চ্যাটার্জি এবং প্রাকৃতে চাটুজ্যে হয়। ঠিক তেমনি যে ব্রাহ্মণ কোনো রাজসভার অন্দরে হস্তিপরিবৃত অবস্থায় সোনার কলসির জলে স্নান করে অভিষিক্ত হতেন তিনিই হলেন বন্দ্যোঘটীয় বা পরবর্তীকালের ব্যানার্জি, বাড়ুজ্যে বা বন্দোপাধ্যায়। রাজসভার ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি প্রধান পুরাণ পাঠক ছিলেন তিনি হলেন মুখোভট্ট অর্থাৎ মুখোপাধ্যায় আর যে ব্রাহ্মণ গঙ্গা নদীর তটসংলগ্ন কোন অংশে বাস কৃতেন তারা ছিলেন গঙ্গাকুলিক বা গঙ্গোপাধ্যায়।যখনি মূল গোত্রনামের সাথে উপাধ্যায় যুক্ত হচ্ছে তখনই পদবীটি থাকছে সংস্কৃত আর তারই মাগধী প্রাকৃতে অপভ্রংশ হয়ে সৃষ্টি হয় চাটুজ্যে, মুখুজ্যে ইত্যাদির। এই উপাধ্যায় শব্দটিরও একটি প্রাকৃত রূপ আছে "ওঝা"। ভাবলেই আশ্চর্য লাগে না, এই অতিপরিচিত পদবীগুলির ইতিহাস এত বর্ণময়!