পৃথিবী জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ। পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে নানা অদ্ভুত প্রাণী। তাদের কারোর খোঁজ ইতিমধ্যেই রয়েছে আমাদের কাছে, কিছু প্রাণীর খোঁজ চলছে আর কিছু প্রাণী আজও আবিষ্কারই হয়নি। নানা আকার, বর্ণ প্রভৃতি নিয়ে এই প্রাণিজগতে বিরাজ করছে প্রচুর প্রাণী। সেরকমই একটি পাখি হলো আন্না'স হামিংবার্ড। হামিংবার্ড নামটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। আর এই হামিংবার্ডেরই একটি প্রজাতি হলো আন্না'স হামিংবার্ড। মাঝারি আকারের এই পাখিটির দেখা মেলে মূলত উত্তর আমেরিকার উপকূলবর্তী এলাকায়। আন্না মাসেনা, ডাচেস অফ রিভোলির নাম থেকে এই পাখিটির নামকরণ করা হয় আন্না'স হামিংবার্ড। এই পাখিটির বিশেষত্ব হলো এই পাখিটি প্রতি সেকেন্ডে তার পালকের বর্ণ পরিবর্তন করে থাকে। এই পাখিটিকে নিয়ে মাতোয়ারা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক এই পাখি সম্পর্কিত কিছু অজানা কথা........
এই পাখিগুলি মূলত ৩.৯ থেকে ৪.৩ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। এই পাখির ঘাড়ের উপরের পালকগুলি হয় চিত্রাভ ব্রোঞ্জ সবুজ রঙের। এর সাথে ধূসর রঙের বুক এবং পেট। শরীরের পাশের পালকগুলি হয় ঘন সবুজ রঙের। ঝুঁটিযুক্ত এই পাখির ঝুঁটি আবার সোজা এবং অনেকটা লম্বা হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ পাখির পিঠের পালকগুলির রং মেয়ে পাখির থেকে বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকে। পুরুষ পাখির চিত্রাভ পালকের রঙ হয় ক্রিমসন রেড যা ম্যাজেন্টা থেকে রেডিশ পিঙ্ক পর্যন্ত শেডের মধ্যে আনাগোনা করে। এই পাখির কণ্ঠভূষণের রঙ হয় হালকা বাদামি যা সরাসরি সূর্যালোক পড়ার ফলে ঘন বাদামী রঙ ধারণ করে থাকে। এই বর্ণটিই হলো আন্না'স হামিংবার্ডের প্রকৃত বর্ণ। এবার আসা যাক রঙ পরিবর্তনের কথায়।
পাখিদের এই বর্ণ পরিবর্তন মূলত হয়ে থাকে তাদের মোল্টিংয়ের কারণে। মোল্টিং কথার অর্থ হলো, পুরোনো সমস্ত পালক ঝরে গিয়ে নতুন পালক জন্মানো। এই মোল্টিং প্রসেস একটি পাখির সম্পূর্ণ বেশভূষণ পরিবর্তিত করে দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই মোল্টিং প্রসেস পাখিদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক হয়ে থাকে। এর জন্য তাদের প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত এনার্জির। প্রকৃতির কোলে এমন অনেক পাখি রয়েছে যারা বছরে একবার করে তাদের পালক ঝরিয়ে থাকে। তাদের গ্রীষ্মকালে একরকম দেখতে হয় আর শীতকালে অন্যরকম দেখতে হয়। বারবার রং পরিবর্তন করা ঐসব পাখিদের জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনক। এর ফলে এই পাখিরা যেমন তাদের শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায় সেরকমই নিজেরাও ভালো শিকার ধরতে পারে। পাখিদের পালক আমাদের নখ ও চুলের মতো মৃত কোষ দিয়ে তৈরী হয়ে থাকে। পাখি যত বড় হতে থাকে নানা কারণের তাদের পালক ঝরার কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই ব্যাপারটি সেখানেই আলাদা। এক্ষেত্রে পাখিরা নিজেদের সমস্ত পালক ঝরিয়ে ফেলে। সেইস্থানে সম্পূর্ণ অন্য রঙের নতুন পালক জন্মায়। পরেরদিকে জন্মানো পালকগুলিতে মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থের পরিমান বেশি থাকে। তাই এই পালকগুলি আগের পালকের থেকে বেশি ডার্ক হয়ে থাকে। পরে জন্মানো পালক আগের থেকে বেশি প্রতিরোধ ক্ষমতাযুক্ত হয়ে থাকে। হামিংবার্ডের ক্ষেত্রেও এইজাতীয় মোল্টিংয়ের ঘটনা দেখা যায়। মূলত গ্রীষ্মকালে এই মোল্টিং বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু আন্না'স হামিংবার্ডের যে বর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় তা কি এই মোল্টিংয়ের কারণেই?
না, আন্না'স হামিংবার্ডের বর্ণ পরিবর্তন মোল্টিংয়ের কারণে হয় না। এই ছোট্ট পাখিটির শরীরে পালকগুলি এমন একটি পর্বে সাজানো থাকে যে আলোর ওয়েব লেংথের উপর নির্ভর করে তার বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই পাখির পালকগুলি চিত্রাভ পালক অর্থাৎ ঘাড়ের উপরের প্রান্তের রঙিন পালকের নিচে সারিবদ্ধভাবে থাকে এয়ার বাবল। এর ফলে সূর্যের আলো এই বুদবুদে লেগে প্রতিফলিত হয়ে যায়। আর এই প্রতিফলনের সাথে সাথেই ছড়িয়ে পড়ে নানা রঙ। আলো সাতটি রঙের সংমিশ্রনে তৈরী হয় এই কথা সকলেই আমরা বিজ্ঞানে পড়েছি। আর সেই রঙ যখন প্রতিফলিত হয় তা সাতটি রঙে বিভক্ত হয়ে যায়। এই পাখির পালকের ক্ষেত্রেও সেই হার্ডকোর ফিজিক্স আমরা দেখতে পাই। এছাড়াও এই পাখির ঘাড়ের কাছের চিত্রাভ পালকগুলি এমনভাবে সাজানো থাকে যে একদিক থেকে দেখলে এক একটি রঙ প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। পাখিটি যখন মাথা ঘোরায় তখন এক একটি কোণ থেকে এক এক রকমের রঙ দেখা যায়। সূর্যের আলো এই পাখির পালকে প্রতিফলিত হওয়ার সময় কিছু আলো পরবর্তী লেয়ারের দিকে চলে যায়। এর ফলে এই রঙ পরিবর্তন তার দিক নির্ধারিত গতির উপর নির্ভর করে আরও তীব্র হয়ে থাকে। এই পাখিটি আমেরিকায় দেখা গেলেও জানা যায় এই পাখিটির বাজার মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ২৫ লক্ষ টাকার সমান। জানা যায়, এই পাখিটির অনন্য বর্ণ পরিবর্তনের জন্যই এতো মূল্যবান।