তামাকের সঙ্গে বিবেকানন্দের বন্ধুত্বটি বংশগত। বাপ বিশ্বনাথ নিজে গড়গড়ায় তামাক খেতেন। লোককেও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তিনি ব্যারিস্টার মানুষ। ফলে, তাঁর কাছে নিত্য নানান জাতের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকত। জাতপাত ভেদাভেদের সে-যুগে তাঁর বৈঠকখানায় এক এক জাতের লোকের জন্য এক একটি গড়গড়া নির্দিষ্ট ছিল। সব্বার স্থির বিশ্বাস বারোয়ারি গড়গড়ায় ধূমপান করলে অর্থাৎ তামাক খেলেই জাত যাবে। ব্যাপারটা খটকা হয়ে বালক বিবেকানন্দের মাথায় ঢুকে গেল। জাত না-হয় যায়, কিন্তু, কীভাবে যায়? ব্যস, ব্যাপারটা হাতেকলমে পরখ করে দেখতে দেরি করলেন না। বাপের বৈঠকখানায় ঢুকে হরেক গড়গড়ায় টান দিতে শুরু করলেন। না, জাতটা দেখলেন কর্পূর নয়! কই উবে তো গেল না! পরীক্ষা সফল হল। কিন্তু, সাইড এফেক্ট হিসেবে ধূমপানে হাতেখড়ি হয়ে গেল। বাবার প্রশ্রয় পেলেন। কিন্তু, পারিবারিক শিক্ষার জোরে আর পাঁচজনের মতো বিগড়ে গেলেন না।
কিশোর বিবেকানন্দের একটি জবরদস্ত নেশা ছিল। তাতে বিশ্বনাথের অনুমোদনের খামতি ছিল না। সে হল, নস্যির নেশা। রাতে উডপেন্সিল দিয়ে ঠুসে ঠুসে নস্যি নিতেন নাকে। হাঁচিতে-শ্লেষ্মাতে তখন মশারি মাখামাখি হত। তার জ্বালায় ভাইয়েরা কিছুতেই তাঁর সঙ্গে শুতে চাইতেন না। পরে অবশ্য নস্যির জায়গা দখল করেছিল তামাক। ধূমপানের সুযোগ না-থাকলে চুন দিয়ে দোক্তার পাতা ডলে খৈনি বানিয়ে ঠোঁটে চেপে রাখতেন।
যৌবনে সন্ন্যাসী হলেন। মঠ হল। অভাব এল। খাওয়ার অনিয়ম হতে লাগল। পরিব্রাজক জীবন হল। তখন বারে বারে অস্বাস্থ্যকর জলহাওয়ার কবলে পড়ে তিনি একসময় ক্রনিক পেটের অসুখে ভুগতে শুরু করলেন। ডাক্তার-বদ্যি হল। কাজের কাজ কিছু হল না। তখন অনেকেই পরামর্শ দিলেন আফিং ধরতে। ধরেও ফেলেছিলেন। কিন্তু, শেষমেশ যাহোক শুভাকাঙ্ক্ষী এক ডাক্তারের ধমকে এই ধরাধরির ইতি হল। রয়ে গেল শুধু তামাক এবং চায়ের নেশা। মঠের অভাব ও আধপেটা খাওয়ার দিনগুলোতে খিদেকে হাতে মারার উপায় হয়ে উঠেছিল সস্তার কালো চা আর হুঁকোর তামাক। তবে, তর-তমের বিচারে তামাকের প্রতিই তিনি ছিলেন সবচেয়ে দুর্বল। তাই, ১৮৯৭ সালে আলমবাজার মঠে যখন সংঘকে বিধি-নিষেধ-নিয়মে বাঁধা হচ্ছে, তখন তিনি সেখানে তামাককে বৈধতা দিয়ে তবেই হাঁফ ছাড়লেন :
"প্রাতে ও সায়াহ্নে জপ ধ্যান, মধ্যাহ্নে বিশ্রামান্তে নিজে নিজে শাস্ত্রগ্রন্থাদি অধ্যয়ন... প্রাতে ও অপরাহ্নে...ডেলসার্ট ব্যায়াম...মাদক দ্রব্যের মধ্যে তামাক ছাড়া আর কিছু চলবে না...।"
হুঁকো-কলকে তাঁর নিত্যসঙ্গী। আর সঙ্গী দা-কাটা তামাক। সেইসঙ্গে একবার পরিব্রাজনকালে তাঁর সঙ্গ নিলেন শরৎ মহারাজ। হুঁকো-তামাক রইল তাঁর জিম্মায়। পথ-চলতে বার বার তামাক খাবার ইচ্ছে হতে লাগল। তখন আগুনের খোঁজ করা, কলকে সাজা--সে এক ঝকমারি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল! স্বামীজীর নিজেরই বিরক্তি ধরে গেল এ ঝঞ্ঝাটে। বিরক্তি জমে রাগ হল। সন্ধেয় আস্তানায় ফিরে সেই রাগ মাথায় উঠল। ফলত, ঝামেলার দফারফা করতে স্বামীজী নিজেই হুঁকো-কলকে আছাড় মেরে ফেলে দিলেন। দোক্তার পাতাও দূর করলেন। শালার তামাকই আর কোনদিন খাব না! শরৎ মহারাজও ভাবলেন, যাক বাবা, ঝামেলা তাহলে মিটল। কিন্তু, ঝামেলা কি আর অত সহজে মেটে! রাত বাড়তেই শুরু হল ভবির খেল। খাওয়া হল। শোয়া হল। দু'প্রহর গেল। তিন প্রহর গেল। স্বামীজীর আর ঘুম আসে না। ভেতর কেবলই আনচান ভাব। কি যেন পাননি, কি যেন হয়নি! অস্বস্তি ক্রমেই বাড়তে লাগল। একসময় আর পারলেন না। ধপ উঠে বসলেন। পাশে ঘুমন্ত শরৎকে একেবারে ঝাঁকিয়ে তুললেন, তামাক খাবো, তামাক সাজ! শরৎ চোখ কচলে বললেন, কল্কে কোথায়? ফেলে দিয়েছ তো! স্বামীজীর ধৈর্য আর ধরে না। খোঁজ না ব্যাটা খোঁজ! তখন, শুরু হল খোঁজা। অন্ধকার হাতড়ে আধভাঙা কলকে অবশ্য পাওয়া গেল। হুঁকোও পাওয়া গেল। কিন্তু, তামাক? সে তো ফেলে দিয়েছ! স্বামীজী অস্থির হয়ে উঠলেন। আমি জানি না, সে তুই যেখান থেকে পারিস জোগাড় কর! শরৎ পড়লেন ফাঁপরে। উপায় কী! হঠাৎ চিড়িক করে উপায় পেলেন স্বামীজী নিজেই। শরতের একশিরা। তাই ওখানে টোটকা ওষুধ হিসেবে তামাকের পাতা বাঁধা। বললেন, দে, ওখান থেকেই দে, এক্ষুনি দে! শরৎ কি আর করেন, বাধ্য হয়ে সেই তামাক দিয়েই হুঁকো সাজলেন। অস্থির স্বামীজী গুড়গুড় করে একরাশ ধুঁয়ো ছেড়ে তবে শান্ত হলেন। শরতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আঃ, বাঁচালি ভাই!
অবশ্য সবসময় যে তাঁর সফরসঙ্গী কেউ-না-কেউ থাকতেন এবং সঙ্গে হুঁকো থাকত--এমনটাও নয়। একবার একা পথে যেতে যেতে ধূমপানের ইচ্ছে চাগাড় দিল। হুঁকো, সিগারেট, চুরুট--যা হোক কিছু একটা হলেই হল। কিন্তু, জায়গাটা এমন যে, চোখের সামনে দোকানদানি কিচ্ছু নেই। কিছুদূর যেতেই দেখলেন রাস্তার ধারে মেথরের দল বসে হুঁকো খাচ্ছে। কিন্তু, ইচ্ছে হলেও তাদের কাছে চাইতে পারলেন না। তিনি সন্ন্যাসী, ওরা মেথর। অবচেতনে অহং এল। কিন্তু, ওদের ছাড়িয়ে গিয়েই বিবেক জাগল--ভেদবুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিতেই কি সংসার ছেড়েছেন! ছি:! নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরলেন। মেথরদের অবাক করে আপন করে তাদের কাছে তামাক খেলেন।
স্বামীজী তামাক খান--এ নিয়ে কি কারও কোন অভিযোগ ছিল না? ছিল বৈকি। স্বামীজীর এক গুরুভাই একবার তো তাঁকে মাথা গরম করে বলেই বসলেন, 'দেখ, তোমার এই অভ্যাসগুলি শোধরানো দরকার। নতুবা তোমার জন্য আমাকে অনেক লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।' কিন্তু, স্বামীজী তাঁকে শান্তভাবে বললেন, 'তুই তোর কাজ কর। আমাকে defend করবার কোন আবশ্যক নেই তো।' ব্যস, পোদ্দারের এই এক ঘায়েই সব চুপ!
তবে, স্বামীজী একবার কিন্তু তামাক ছাড়তে মনস্থির করেছিলেন। স্বামী শুদ্ধানন্দ সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন। স্বামীজী তখন সবে আমেরিকার ধর্মমহাসভায় ভাষণ দিয়ে বিদেশ-বিখ্যাত হয়ে ফিরেছেন। উঠেছেন কাশীপুরে, গোপাললাল শীলের বাগানবাড়িতে। স্বামী শুদ্ধানন্দের বর্ণনায় :
"স্বামীজী এসে বসেছেন, আমিও গিয়ে প্রণাম করে বসেছি, সেখানে আর কেউ নেই। হঠাৎ কেন জানিনা-- স্বামীজী আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুই কি তামাক খাস?'
আমি বললাম, 'আজ্ঞে না।'
তাতে স্বামীজী বললেন, 'হাঁ, অনেকে বলে--তামাকটা খাওয়া ভাল নয়; আমিও ছাড়বার চেষ্টা করছি।" চেষ্টা করেছেন। পারেননি। যে মানুষটা অনায়াসে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হতে পেরেছিলেন, সেই মানুষটা সামান্য তামাক ছাড়তে পারলেন না ? আসলে, তিনি যেমন করে তামাক ধরেছিলেন, তেমন করে ছাড়তে চাননি। তামাকও বোধহয় তাঁকে ছাড়তে চায়নি। নেশাভ্যাসের যা নিয়ম আর কী !
তথ্যঋণ :
'স্মৃতির আলোয় স্বামীজী'-- স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ সম্পাদিত।
'শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী'--মহেন্দ্রনাথ দত্ত।