এক ১৩ বছরের কিশোরী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তা। আপন মনে রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছে সেই মেয়ে। নিজের জগতে নিবিষ্ট। হঠাৎ করে একটা গাড়ি ধাক্কা দেয় মেয়েটাকে। গাড়িটা প্রায় পিষে দিয়েছিল মেয়েটাকে। দলা পাকিয়ে গিয়েছিল শরীরের নানা অঙ্গ। সেই মেয়েটার মায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়েটার অঙ্গদান করা হবে। এমন দুর্ঘটনার পর যথারীতি রাস্তাতেই মারা যায় মেয়েটা। মা তখন শোকগ্রস্ত। তবুও চেয়েছিল সে মেয়ের অঙ্গদান করতে। কিন্তু দুর্ঘটনার তীব্রতায় সেই মেয়েটির শরীরের নষ্ট হয়ে যাওয়া কোন অঙ্গই দান করা সম্ভব হয়নি মায়ের পক্ষে।
ক্ষোভ, যন্ত্রণা, হতাশায় বিধ্বস্ত হচ্ছে মা। ছুটে গেল পুলিশের কাছে। ড্রাইভারের নামে অভিযোগ করতে। পুলিশ বলেছিল ''অভিযোগ নিয়ে নিচ্ছি, কিন্তু এই ড্রাইভারকে দুদিনও আটকে রাখা যাবে না থানায়। মদ খেয়ে গাড়ি চালানোর অভ্যাস আছে ওর। এইতো পরশুদিনে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। জেলে ঢুকেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়া পেয়ে গেছে।'' পুলিশের কথায় তাচ্ছিল্য। মায়ের ভেতরের যন্ত্রণা তখন তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সন্তানের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। মন কিছুতেই মানছে না সন্তানের মৃত্যু। তার ওপর পুলিশের ওই তুচ্ছ করার মনোভাব মায়ের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। নীরবে নিভৃতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়নি সেই মা। বরং শোকের অন্ধকার থেকে আলোর দিশা খুঁজে পেয়েছে আর পথ দেখিয়েছে এমন অজস্র মাকে। এই মায়ের নাম ক্যান্ডি লাইটনার।
১৯৪৬ সালে জন্ম ক্যান্ডি লাইটনারের। দুই যমজ মেয়ে ও এক ছেলের মা ক্যান্ডি। তার এক কন্যা ক্যারি একটি আকস্মিক পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। চালকটি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল। পুলিশের কাছে খোঁজ নিতে গিয়ে ক্যান্ডি জানতে পেরেছিল এই ড্রাইভার এর আগেও এমন রেকর্ড আছে। এই ড্রাইভারের কাছে মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই। এর আগেও দুবার এমন মৃত্যুর কারণ হয়েছে সে।
ক্যান্ডির যাত্রা পথ এখান থেকেই শুরু হয়। যে সমস্ত মায়েরা তাদের সন্তানদের হারিয়েছে পথ দুর্ঘটনায় তাদের কাছে পৌঁছয় ক্যান্ডি। আবেদন জানায় সে। সকলকে একত্রিত করে ক্যান্ডি। সে গড়ে তোলে একটি সংস্থা। ম্যাড (মাদার্স অ্যাগেন্সট ড্রাঙ্ক ড্রাইভিং)। এই সংস্থা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে।
যে চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীন গাড়ি চালানোর কারণে ক্যান্ডির সন্তান মারা যায়, ক্যান্ডি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল এই একই ভুল দুবার করার পরেও তার লাইসেন্স বাতিল হয়নি। তাই লড়াই করে ক্যান্ডি এই সংস্থা তৈরি করে। ম্যাড এই আইন প্রণয়নের চেষ্টা করে যে অ্যালকোহল পান করে গাড়ি চালালে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আইন প্রণয়ন করেছিল।
ক্যান্ডির নিজের জীবনও ছিল পাথুরে। ১৯৬৪ সালে স্নাতক হওয়ার পরেই ক্যান্ডি নিজে উপার্জন করার পথ বেছে নেয়। যদিও এর সঙ্গে এসে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিল। তারপর বিয়ে করে ক্যান্ডি। স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে তিন সন্তান ছিল ক্যান্ডির কোলে। সন্তানদের একাই মানুষ করেছিল সে।
মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে ঘাট দুর্ঘটনায় ক্যান্ডিকে বারবার ভুগতে হয়েছে। তার ছেলের বয়স যখন চার, গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হয় সে। এমনকি শরীরের একটা অংশ প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিল সেই ছেলের। ক্যান্ডির মায়ের একজন পরিচিত আত্মীয় গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। এই প্রত্যেকটা গাড়ি দুর্ঘটনার কারণই ছিল মদ্যপ অবস্থায় ড্রাইভারের গাড়ি চালানো। বারবার ক্যান্ডির মনে হতো, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কোন শাস্তি হয় না কেন! যারা তাদের আপনজনদের হারায় এসব কারণে, তাদের যন্ত্রণার উপশমের কি কোন জায়গা নেই? এই ভাবনা তার মনে ফুলের মত অর্ধেক প্রস্ফূটিত হয়ে রয়ে গিয়েছিল। তারপর নিজের কিশোরী মেয়ের মৃত্যু সেই ফুলকে লতাপাতা সমেত বিস্তৃত করে। ক্যান্ডির উদ্যোগেই জন্ম নেয় সংস্থা ম্যাড। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেকটি রাজ্যে এদের দপ্তর রয়েছে। কানাডায় ও এরা কাজ করে। পরিসংখ্যান বলছে এই সংস্থা আসার পর পথ দুর্ঘটনা সেখানে কমেছে অর্ধেকের থেকেও বেশি। এভাবেই এক মায়ের শোকের অন্ধকার থেকে জোনাকি পোকার মতো অজস্র আলো জন্ম নিয়েছিল।