সদ্য সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেছেন আর দূরের কোথাও থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর, মনটা হঠাৎ করে খুব ভালো হয়ে যায়তো। আপনি মনে মনে ভাবতে থাকেন বোধহয় কোথাও বিয়ে হচ্ছে, ইচ্ছে হয় নিশ্চয়ই সেজে গুজে একটা বিয়ে বাড়ি গেলে মন্দ হত না। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন এই শহর কলকাতার বয়স যখন আরও কম ছিল, রাস্তায় ছিল অনেক ঘোড়ার গাড়ি তখন ঠিক কেমন ছিল এই কলকাতার বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান? সেই গল্পই আজ বলবো আপনাদের। আগে কলকাতায় বিয়েবাড়িতে কি কি খাওয়ানো হতো জানেন কি? অষ্টাদশ শতকে সাধারণ বাঙালি বিয়ে বাড়িতে ভোজের জায়গায় রাজ করতো ভোজপান্ডারা, খাওয়ানো হতো ভাত ডাল পাঁচভাজা প্রভৃতি। কারো কারো জন্য ফলারেরও ব্যবস্থা থাকতো বটে কিন্তু লুচি তরকারি সাধারণত খাওয়ানো হতোনা বললেই চলে, অবশ্য রাজারাজড়া দের ব্যাপার ছিল আলাদা। আর একটা বিষয় ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভোজের জায়গায় কার আসন কোথায় হবে- সবার আগে ভোজন করাতে হতো ব্রাহ্মণদের, বরকর্তা বা কন্যাকর্তা কে নিমন্ত্রিতদের মাঝে গিয়ে ব্রাহ্মণদের অনুরোধ করে বলতে হতো 'আপনারা দয়া করে উঠে আসুন আপনাদের জন্য সামান্য কিছুর আয়োজন করেছি', এই ব্রাহ্মণদের খাওয়ার পরিবেশন করানোও হতো ব্রাহ্মণ রাঁধুনি ঠাকুরদের দিয়েই, তারপর খাওয়া শেষ হয়ে গেলে তাদের হাতে তুলে দিতে হতো সাধ্যমতো দক্ষিনা, মোটামুটি ২৫পয়সা থেকে ১ টাকা। এরপর অন্যান্যদের জন্যে ভোজের আয়োজন করা হতো।
যাদের কে নিমন্ত্রণ করে আনা হতো তাদের ভোজের আয়োজন করা হতো নিমন্ত্রণকর্তার নিজের বাড়িতেই, ভাড়াবাড়িতে ভোজ খাওয়ানো অপমানজনক হিসেবেই মনে করা হতো। মেঝের ওপর আসন পেতে কলা পাতায় খাদ্য পরিবেশন করাই ছিল দস্তুর। কলাপাতার এককোনে রাখা হতো একটুকরো পাতিলেবু আর নুন, জল, দুধ অথবা ক্ষীর দেওয়ার জন্য রাখা হতো মাটির খুরি। প্রথমেই পাতায় এসে পড়তো লুচি আর বেগুন ভাজা, কখনো পটোল ভাজাও থাকতো বটে, তারপর আস্ত কুমড়োর ছক্কা, বাঁধাকপির তরকারি, ডাল, ধোঁকার তরকারি, আলুরদম, মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় আর শেষে মিষ্টি, সাধারণত বিবাহ বা অন্য কোনও শুভ অনুষ্ঠানে মাংস খাওয়ানোর রীতি তখন ছিলোনা, যদিও এক্ষেত্রেও অভিজাতদের ব্যাপার ছিল খানিক আলাদা। খাওয়া শেষ হওয়ার পর দেওয়া হতো পান। পরিবেশনকারীরা বার বার এসে নিমন্ত্রিতদের জিগ্যেস করে যেত তাদের কিছু চাই কিনা, সবাই যেন তৃপ্তি পায় সেটাই ছিল আসল উদ্যেশ্য। অনেক নিমন্ত্রিত বাড়ির লোকেদের জন্যেও চাদরে বেঁধে নিয়ে যেত কিছু শুকনো খাবার লুচি মন্ডা ইত্যাদি, একে বলা হতো ছাঁদা বাঁধা। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ভোজ বাড়ির কর্তা সমস্ত নিমন্ত্রিত কে জোড়হাতে জিগেস করতো যে তাঁরা তৃপ্তি পেয়েছেন কিনা।মেয়েদের খাওয়ানোর জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা থাকতো, সেখানে পরিবেশনও করতো মহিলারা। বিয়েবাড়িতে আর একটা বিষয় নিয়ে তখন ভাবা হতো খুব, তা হলো উপহার দেওয়া, সাজপোশাক তো ছিলই তবে তা যে বিয়ে বাড়ির জন্য আলাদা কিছু হবে তেমন নয়, অবশ্যই কিছু জাঁক ছিল বটে তবে তা যে অন্যান্য উৎসবেও থাকতনা তেমন নয়, ছেলেদের হাতে বেল ফুলের মালা পরনে গিলে করা পাঞ্জাবি আর ময়ূরপুচ্ছ ধুতি, মেয়েদের সাধারণত বেনারসি আর সোনার গয়না, খোঁপায় জুঁই বা বেলের মালা, সুগন্ধি ব্যবহারের রীতি ছিল স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে, মহিলারা ঠোঁট রাঙানোর জন্য পান খেতেন।
আজকের ফিউশনের জমানায় মনে হচ্ছে তো, এভাবেও কখনও বিয়ে বাড়ির খাওয়া দাওয়ার চল ছিল! এখন তো বাড়িতেও আমরা এরকম খাবার দাবার খাই না, ঠিক কি না? কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। এই রকমই ছিল আগেকার বিয়েবাড়ির খাওয়া দাওয়া।