জাদুঘরের রূপকথা - পর্ব ৬

তখন কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট ছিল কিংসফোর্ড। তাঁকে হত্যার চেষ্টা কম হয়নি। অত্যাচারী এই ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লবীদের সঙ্গে পশুর মত আচরন করত।

এই ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার চেষ্টার অপরাধে ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসির দড়ি গলায় পরেন। তাঁকে লক্ষ্য করে যে বোমাটি ছোড়া হয়েছিল, তার আকৃতি বইয়ের মত। নাম 'বুক বম্ব'। এই বই আকৃতির বোমা আজও সংরক্ষিত রয়েছে এই কলকাতারই বুকে। এক জাদুঘরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতার বুকে আঘাত হেনেছিল যে বোমা তাও স্বচক্ষে দেখা যেতে পারে এই জাদুঘরে।

এমন সব যুদ্ধের কথা শুনলেই দুশ্চিন্তা, আশংকা চেপে বসে আমাদের মনে।

কিন্তু একটা ভাঙনের পর গড়ে ওঠার অপেক্ষা থাকে। সেই অপেক্ষার মুহূর্তগুলো যদি ধরা থাকে কোনো স্মৃতি-ঘরের দেওয়ালে! তেমন জাদুঘর কোথায়?

তেমন গল্পের মত জাদুঘর আছে এই কলকাতার বুকে।

ঠিকানা-১১৩, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা।

জাদুঘরের এই ভবনটি মোটেই সাধারণ কোনো বাড়ি নয়।

এই বাড়িতেই নবজাগরণের প্রাণপুরুষ বাস করতেন। নারীদের যন্ত্রণা যে পুরুষের হৃদয়কে ব্যথিত করেছিল। তাই এই সংস্কারক মানুষটি সতীদাহ প্রথা রদ করার কথা চিন্তা করেছিলেন এই বাড়িতে বসেই।

PoliceMuseum1

রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোডের এই বাড়িতে বাস করতেন রাজা রামমোহন রায়।

১৯৯৬ সালে এটি অধিগ্রহণ করে কলকাতা পুলিশ। তারপর এখানে সাজিয়ে রাখা হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত লড়াই এবং স্বাধীন ভারত গড়ে ওঠার সব স্মৃতি-কণাদের।

নবজাগরণের প্রাণপুরুষের এই বাসস্থান রূপান্তরিত হয় জাদুঘরে।

সোমবার বাদে সপ্তাহের বাকী ছ'দিনই খোলা থাকে এই জাদুঘর।

সময় সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।

প্রয়োজন হয় না কোনও প্রবেশ মূল্যের। তবে অনুমতি নেই ছবি তোলার।

জাদুঘরে প্রবেশের আগেই সই করতে হয় একটি রেজিস্টারে।

নিজের নাম নথিভুক্ত করে তবেই প্রবেশ করা যায় এখানে। সঙ্গে রাখতে হয় বৈধ পরিচয় পত্র।

এই জাদুঘরের প্রথম ঘরটি আধুনিক অন্ধকার জগতের বিরুদ্ধে কলকাতা পুলিশের লড়াইয়ের নিদর্শন।

কলকাতা পুলিশ কিভাবে সন্ত্রাসবাদ এবং বেআইনি ড্রাগ পাচার চক্রকে ঘায়েল করেছিল তার সব নিদর্শন রয়েছে এখানে।

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর কিভাবে নানা রহস্যের সমাধান করেছে তারও নিদর্শন মেলে এখানে।

একবার একটি ছোট্ট কলমের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য পাচার করা হচ্ছিলো। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেটি উদ্ধার করে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর। সেটিও চাক্ষুষ করা যেতে পারে এখানে।

১৯৬৯ সাল। হঠাৎ করে কলকাতা পুলিশের কাছে খবর আসে বোমার আঘাতের আশঙ্কার। যে বোমা নেমে আসতে পারে এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে।

PoliceMuseum2

যথারীতি দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা বেরিয়ে পড়লেন সেই ঘাতককে খুঁজতে। চারিদিকে চষে ফেললেন তারা। কোথাও কোন নিদর্শন নেই। কিন্তু বারবার তাঁদের মনে হচ্ছে, সমস্যাটা বিমানবন্দরেই রয়েছে। অবশেষে উদ্ধার হলো। একটা ছোট্ট কলম পড়েছিল বিমানবন্দরে। দেখা গেল তার মধ্যেই রয়েছে কলকাতাকে ধ্বংস করার সেই বস্তু। বোমা।

এভাবেই আমাদের প্রিয় শহরকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার থেকে বারবার বাঁচিয়েছে সামরিক কর্তারা। সেইসব নিদর্শন ধরা রয়েছে এই জাদুঘরে।

বাকি ঘরগুলোতে যত এগোনো যায় পিছিয়ে যায় সময়। চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী।

সেই সময় ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র দেখার সুযোগ এখানে রয়েছে।

এমনকি পুরনো যানবাহনের অংশও রাখা রয়েছে। স্বাধীনতার লড়াইয়ে ব্যবহৃত গাড়ির নানা টুকরো দেখে ইতি-উতি স্মৃতিরা ভেসে ওঠে। রচিত হয় দৃশ্যকল্প।

এই জাদুঘরের অন্যতম প্রধান উল্লেখ্য বিষয় চৌষট্টিটি ফাইল। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর পরিবারের মানুষ সম্পর্কিত এই ফাইলগুলো রাখা রয়েছে কলকাতার এই সামরিক-জাদুঘরে।

এত স্মৃতি-ভ্রমণ করার পর ক্লান্ত? তার ব্যবস্থাও আছে এখানে। ক্যাফেটেরিয়ায় কফির কাপে চুমুক দিয়ে অন্তরে স্মৃতির ওম নিয়ে ফিরতে হবে এই জাদুঘর থেকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...