ব্রোকেন চেয়ার—নামটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে তাই না? হওয়ারই কথা। একটা ভাঙা চেয়ার, তাকে নিয়ে আবার সাতকাহন লেখার আছেটা কী? আছে আছে মশাই অনেক কিছুই লেখার আছে। মনে পড়ে 'হীরক রাজার দেশে' ছবির সত্যজিত রায়ের লেখা সেই অবিস্মরণীয় গান— "এই দুনিয়ায় আছে দেখবার কতো কী জানার কতো কী শেখার"?..এ তো আর বাড়ির গুদামঘরে ভাঙাচোরা পুরনো জিনিসের মধ্যে পড়ে থাকা যেকোন ঠ্যাংভাঙা চেয়ার নয়, এই ব্রোকেন চেয়ার হলো পৃথিবী বিখ্যাত একটি ভাস্কর্য।
একটা বিশাল চেয়ার। হিসেব মতো তার চারটে পায়ে দাঁড়ানোর কথা কিন্তু সে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি পায়ের উপরে আর সামনের বাঁ পাটা তার ভাঙা। ভাঙা পা-টা দেখলে মনে হবে যেন কোনো বোমা বিস্ফোরণে সেটা উড়ে গিয়েছে।
আপনি বলবেন তো তিন পা নিয়ে আবার কোনো চেয়ার দাঁড়াতে পারে নাকি? সে তো উল্টে পড়ে যাবে?
না মশাই! সব সময় দুয়ে-দুয়ে চার হয় না। কখনো কখনো তিন-ও হয়।
যখন একটা বিশেষ চেয়ার বিশেষ ভাবে বানানোই হয় তিনটি পায়ার উপর এবং যেটা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। ঠিক ধরেছেন যেখানে ইউনাইটেড নেশনস এর অফিস। এবং সেই জাতি সংঘের অফিসের গেটের ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে এই "ব্রোকেন চেয়ার"-ল্যান্ডমাইনে ও ক্লাস্টার বোমা বিস্ফোরণে পঙ্গুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে।
এবার চলুন একটু জেনে নিই এই "ভাঙা চেয়ার" গড়ার কথা। এর এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের এনজিও প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক পল ভারমূলের ব্রেন চাইল্ড হলো এই ব্রোকেন চেয়ার। ১৯৯৬ এর অক্টোবরে তিনি সুইস ভাস্কর ড্যানিয়েল বারসেটকে অনুরোধ করেন একটি দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া চেয়ার তৈরি করতে যেটা হয়ে উঠবে সশস্ত্র হিংসার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদের প্রতীক। সেই মতো তৈরি হয় এই চেয়ার, যেটা ১৯৯৭ সালে ডিসেম্বর বিভিন্ন দেশ যখন এক ল্যান্ড মাইন বিরোধী চুক্তিতে সই করে (যা অটোয়া চুক্তি নামে পরিচিত) তার ঠিক চারমাস আগে ১৮ই আগস্ট ১৯৯৭তে জেনেভায় ইউনাইটেড নেশনস অফিসের ফটকের বিপরীতে বসানো হয় । উদ্দেশ্য ছিল ল্যান্ডমাইনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং আরো বহু দেশ যাতে এই ল্যান্ডমাইন বিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তার প্রচেষ্টা।
এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প প্রতীকী হিসেবে খ্যাত বারো মিটার উঁচু এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছিল পাঁচ টন কাঠ দিয়ে । চেয়ারটি যেখানে বসানো তার নিচে ভূমিতে খোদাই করে লেখা আছে "সশস্ত্র হিংসার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। এই ভাঙা চেয়ার হচ্ছে ভঙ্গুরতা ও সামর্থ্য, অনিশ্চয়তা ও স্থিতিশীলতা, নিষ্ঠুরতা ও মর্যাদার প্রতীক"।
১৯৯৭ সালে প্রথম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে ল্যান্ড মাইন নিষিদ্ধ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং পরে ২০০৭ সালে ক্লাস্টার বোমা নিষিদ্ধের লক্ষ্য নিয়ে এই ভাঙা চেয়ার স্থাপন করা হলেও এটিকে বর্তমানে ল্যান্ড মাইন ও ক্লাস্টার বোমায় অসামরিক লোকজনের ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে এক মূর্ত প্রতিবাদ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তাহলে আর দেরি কেন? কবিগুরু তো কবেই বলে গেছেন "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে".. সশরীরে উপস্থিত হতে না পারি মানস চোখে তো দেখে নিতেই পারি এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে ল্যান্ডমাইন বিরোধিতার মূর্ত প্রতীক অসামান্য এই ভাস্কর্য "ব্রোকেন চেয়ার"...
ছবিঃ স্নিগ্ধা রায়