ভিশন-পাসিং-ক্রসিং ইতালির সেরা শিল্পী ফুটবলার

"কোনো সন্দেহই নেই ও আধুনিক ফুটবলের সবথেকে স্কিলফুল নম্বর টেন .. যে গোল করাতেও পারে আবার গোল করতেও প্রশ্নাতীত ভাবে দক্ষ" - মাইকেল লাউড্রাপ এটাই বলেছিলেন ১৯৯৫ সালে। ভিশন , পাসিং , ক্রসিং সব দিক থেকেই সেই প্রজন্মের অসাধারণ প্লেমেকার। যিনি ক্যারিয়ার এর অধিকাংশ সময়ই সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসাবে খেলেছেন , গোলের তিন কাঠি খুব ভালো চেনার দক্ষতা আর দুর্দান্ত এসিস্ট করার সহজাত প্রবণতার জন্য .. প্লাতিনি বলতেন "নাইন অ্যান্ড হাফ" কারণ ঠিক প্লেমেকার আর স্ট্রাইকার এর মাঝামাঝি একটা অদ্ভুত জায়গা থেকে টিমের আক্রমনভাগের সেরা স্থপতি হয়ে উঠেছিলেন' তিনি রবার্তো বাজ্জিও।

baggio-2

 

১৮ বছর বয়সে ভিসেঞ্জা থেকে ফিওরেন্টিনাতে যোগদানের ঠিক আগে ডান হাঁটুর লিগামেন্টে ২২০ টা স্টিচের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা .. এমনকি নিজের মাকে বলেই ফেলেছিলেন "আমাকে যদি ভালোবাসো , তাহলে আমায় মেরে ফেলো" প্রায় অনিশ্চিত ফুটবল জীবন ... কিন্তু ফিওরেন্টিনা বুঝতে পেরেছিল নিশ্চই ওই পা ফুটবলের মাঠে ঠিক কী কী করতে পারে ! হাল ছাড়েনি তারা , করিয়েছিল চিকিৎসা ... সেখান থেকে পরে জুভেন্টাস , সেরি আ তথা বিশ্ব ফুটবলের সেই সময়ের হিরো হয়ে ওঠা ..

১১৯৪ বিশ্বকাপ .. কোনও রকমে গ্রুপ পর্ব থেকে শেষ ষোলোতে ওঠা ইতালির সামনাসামনি নাইজেরিয়ান সুপার ঈগলের দল .. এই পর্ব থেকেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠলেন "ডিভাইন পনিটেল" সমতা ফেরানোর গোল এবং আরো একটি পেনাল্টি থেকে গোল নাইজেরিয়াকে দেশে ফেরার টিকিট ধরিয়ে দেয় .. কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের কিপার জুবিজারেতাকে ওয়ান টু ওয়ান পরাস্ত করার ছবি নিশ্চয় মনে আছে ? সেমিফাইনালে দুটি গোল করে বশ মানান স্টোইচকভদের বুলগেরিয়াকেও...কিন্তু মাশুল দিতেও কী হয়নি ? চোটটা না লাগলে কী ফাইনাল ম্যাচটা পেনাল্টি অব্দি যেতে দিতেন?

তারপর সেই মিসের পর মাথা নিচু , কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিধ্বস্ত চেহারাটার দিকে সমালোচনার তীর , ভুলেই যাওয়া হল ইতালির আক্রমভাগে সোনার অবদান প্রায় ! ইতালির ফুটবলের যে সূর্য ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আগে মধ্যগগনে উদ্দীপ্ত হয়ে থাকতো , সেই একটা মিসের পর যেনো শুরু হলো গ্রহণ .. জুভেন্তাসে দেল পিয়েরোর উত্থান এক ঝটকায় পিছনের সারিতে নিয়ে চলে এলো আপনাকে .. ভাবা যায় বেতনের ৫০ ভাগ কম অর্থ নিতে বলা হয়েছিল সেই সময় ??!! এরপর এ সি মিলান .. কিন্তু প্রথম একাদশে সেরকম নিয়মিত হয়ে ওঠা হয়নি .. হতাশায় বলেই ফেললেন “আমার মনে হচ্ছে আমি একটা ফেরারি যেটাকে একজন ট্রাফিক ওয়ার্ডেন চালনা করছে।” ১৯৯৪ এর পর মাত্র তিন বছরের মধ্যেই এই পতন! এরপর বোলগনা..

নতুন রূপে রবার্তো বাজ্জিও .. পনিটেল উধাও ,  নিজেকে পুনরাবিষ্কারের নেশায় মত্ত .. ২২ টা গোল ওই সিজনে !! সেই চিপ , ফ্রী কিক আর অসহায় গোলকিপারদের পাশ দিয়ে বল জালে জড়ানো .. চূড়ান্ত ফর্মের বাতিস্তুতা , দেল পিয়েরোদের পিছনে ফেলে ... জায়গা হলো ফ্রান্স বিশ্বকাপগামী বিমানে .. চিলির বিরুদ্ধে পেনাল্টি থেকে একটা গোল করে কিছুটা হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করলেন , কিন্তু এরপর আর আজুরী জার্সি পড়ার সৌভাগ্য হয়নি .. ইন্টারমিলান , ব্রেসিয়ার হয়ে খেলেও নয় .. স্বীকারোক্তি বেরোল মুখ থেকে ‘যেদিন বুটজোড়া তুলে রাখব , যেন মুক্তি পেয়ে যাব’ ...

কিছুটা অভিমান থেকেই কী আর ফুটবলমুখী হলেন না? হিউম্যান রাইটসের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন , ম্যান অফ পিস পুরস্কার পেয়েছেন , কিন্তু কোচিং কেন নয়? "ফুটবল ছাড়াই আমি ভাল আছি" বরাবর বলে এসেছেন এই একটাই কথা অথচ ইতালির হয়ে ৫৬ ম্যাচে ২৭ গোল , দেল পিয়েরোর সাথে চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা তো সেই "ডিভাইন পনিটেল" রবার্তো বাজ্জিওই। কলঙ্ক একটাই ওই স্পট কিক মিস।

 

শুরুর সেই সময়

শরীরের ভেতরে অগুন্তি সেলাই। পেইন কিলারের অ্যালার্জিতে তাঁর প্রত্যেকটা জানান দিতে থাকে। কখনো একসঙ্গে,  কখনও একটার পর একটা। কখনও আলাদা আলাদা, কখনো সদলবলে জোট বেঁধে। আঠারোর ছেলেটির এই জ্বালা আর সহ্য হত না।

ডাক্তার সেই কবেই বলে দিয়েছেন, খেলার আশা ছেড়ে দাও। তবু মন মানে না। তবু এতো কষ্ট কেন? কেন খেলতে না পারার যন্ত্রণার সঙ্গে শরীরের ভেতরে বাইরে চোটের নুনছিটে! এর চেয়ে মৃত্যুও ভাল। এমনই ভাবত ছেলেটা।

ওরম মনে হয় মনের টালমাটাল অবস্থায়। তখন টিন এজার রবার্তো বাজ্জিওরও তাই মনে হয়েছিল । কিন্তু শুরুতেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে ফিরে এসেছিলেন খেলায়। তারপরে আবার বড় বিপদকে হারিয়ে ফিরেছেন। এভাবে বারবার ফেরার লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছেন তিনি।

 

baggio-1

 

১৯৯৪ বিশ্বকাপের সেই  ফাইনাল ও স্পট কিক

কিন্তু, ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষে প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের হাতে জয়মুকুটটা তুলে দিয়ে চরম বিষাদ আর তিক্ততা কিংবা দেশজোড়া ক্ষুব্ধ আর হিংস্র সমর্থকদের মুখের দিকে তাকিয়ে ১৮ বছর বয়সের সেই অনুভূতিটাই কি ফিরে আসেনি প্রতিক্ষণে? ততদিনে তো ধর্ম বদলে 'বুদ্ধিস্ট' হয়ে আরো ধর্মপ্রাণ বাজ্জিও। কিন্তু শেষমেষ তিনি মানুষ তো। তাই আরো কয়েক বছর যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর পর পাপমুক্তি পেরিয়ে প্রশ্নটা এলে জবাব দিতে এতটুকু ভাবেন না সুদর্শন। 'আপনার মনে সম্ভাব্য যা যা আসতে পারে তার সবই এসেছিল আমার মনে'-  সরল স্বীকারোক্তি বাজ্জিওর, এক সাক্ষাৎকারে।

১৯৯৪র বিশ্বকাপ। ইতালির সেরা স্ট্রাইকার বাজ্জিও। গোল্ডেন বলের দাবিদারও। অসম্ভব মেধাবী এবং প্রখর অনুমানশক্তির গেমমেকার। দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেও আতঙ্ক জাগান। বৃত্তের মাঝামাঝি থেকে জালের ওপারে প্রাণের উন্মাদনায় ভরা এক ফুটবলার। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে কখনো প্রতিপক্ষের ঘর ভাঙেন তো নিপাট মিডফিল্ডার হিসেবে নিজের ঘরে সৃষ্টিসুখ আনেন।

চোখ জুড়ায়, মন ভরায়, চিন্তাভাবনা ফুরায় যার খেলা দেখলে। সেবার আমেরিকা মজেছিল বাজ্জিওতে। পাঁচটি গোল করে ইতালিকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। ১২ বছর পর আবার ফাইনালে ইতালী। সবাই ভাবলেন, বাজ্জিওতে এবার বাজিমাত হবে ইতালির, ১৯৮২ সালের পর আবার। ফুটবল বিধাতা কিন্তু আড়ালে হাসছিলেন নিজের মনে।

ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোলের ফাইনালে প্রায় লাখখানেক দর্শক। তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়। দুই বড় শক্তির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নির্ধারিত সময়ে গোল হলনা। অতিরিক্ত সময় শেষেও ০-০। অত:পর পেনাল্টি শ্যুট আউট। এবং খেলা গিয়ে দাঁড়াল ঐ বিশ্বকাপের অন্যতম নায়ক বাজ্জিওর পায়ে। শিরোপা নির্ধারণকারী পেনাল্টি শ্যুটআউট।

সেট পিস স্পেশালিস্ট হিসেবে তার আগেই ইতিহাসে অমরত্ব মিলেছে তার। ইতালিয়ানরা শটের আগে একশ শতাংশ নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু বাজ্জিওর শটের জেরে বল যেন পাখা মেলে বারের বেশ ওপর থেকে উড়ে গেল কোন অজানায়। হতভম্ব বাজ্জিও কোমরে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রক্তাক্ত হতে থাকলেন, পেছনে ছুটে আসতে থাকেন ওই শটের জেরে বিশ্বকাপ ফিরে পাওয়া ব্রাজিলের ফুটবলাররা, সামনে হাঁটু মুড়ে গোলরক্ষক টাফারেলের সেকি চিৎকার!

এই ছবিটা বাজ্জিওর খুনে যন্ত্রণার সাথে স্থায়ী হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে। এক মুহূর্তে স্বর্গ থেকে পতন, নায়ক থেকে ভিলেন, সিংহাসন থেকে আস্তাকুড়েতে। কি নির্মম এই ফুটবল খেলা! সেই হৃদয়ভাঙা গল্প বয়ে বেড়ানো বাজ্জিও একটু একটু করে স্বাভাবিক হন অনেদিন ধরে। বলেছিলেন, 'যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখে গিয়েছিলাম।'

 

শাপমোচন বা প্রায়শ্চিত্ত

 

তার জীবনটাই তো আসলে একের পর এক লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানর আর ফিরে আসার অন্তহীন গল্প। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ফুটবল-প্রাণদন্ডের আদেশ পাওয়া  বাজ্জিও ফ্রান্সের জমিতে জামিনে মুক্তি পান চার বছর পর। ১৯৯৮'র বিশ্বকাপে। টানা তিনটি বিশ্বকাপে মোট নয়টি গোল করা একমাত্র ইতালিয়ান  ততদিনে ঝুঁটিওয়ালা হয়ে গেছেন।

১৯৯৮ সালে ইতালি শুরু করলো চিলির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। খেলা শেষের পথে। ১-২ পিছিয়ে ইতালি। এই সময় বাজ্জিওর কারণে পেনাল্টি পেলো ইতালি। কে নেবেন সে শট? এগিয়ে আসেন দুর্ভাগা বাজ্জিও। সেই ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ হারানো পেনাল্টি শটের পর আর কখনো ভাগ্যের খেলার পেনাল্টি কিক মারেননি তিনি। কিন্তু কারো কারো সাহসের মৃত্যু হয়না কোনদিন।

পেনাল্টি থেকে গোল করে বাজ্জিও হার বাঁচান ইতালির। চার বছর আগের শাপমোচন বা প্রায়শ্চিত্ত ওখানেই। বুকের ওপর থেকে পাথরটা সরে গেলে দীর্ঘ নি:শ্বাস টেনে বাজ্জিও বলেছিলেন, 'যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম।'

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...