চলে গেলেন এ যুগের তানসেন

তাঁকে বলা হতো একালের তানসেন।তাঁর নামে নাসা (NASA) একটি ছোট গ্ৰহের নামকরণ করেছে । অথচ মহাকাশ গবেষণার ধারে পাশেও তিনি কখনো যান নি। তিনি ছিলেন সুরসাধক। সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে দিতেন এই পৃথিবীর আকাশে বাতাসে। হয়তো বা এই মহাবিশ্বের "চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা"য়। তাই এই বিরল সম্মান প্রদান করা হয়েছিল তাঁকে... তিনি.. ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র সুরসম্রাট পণ্ডিত যশরাজ। প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে এই দুর্লভ সম্মান লাভ করেন তিনি। এর আগে তাঁর নামে একখণ্ড চাঁদের ও নাম রাখা হয়েছিল।

শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ তাঁর। জন্মও হরিয়ানার এক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবারে ১৯৩০ এর জানুয়ারিতে। বাবা পণ্ডিত মতিরাম চেয়েছিলেন ছেলে তবলাশিল্পী হোক। সেইমতো তালিম ও চলছিল পুরোদমে। কিন্তু চোদ্দ বছর বয়সে একদিন বেগম আখতারের গান শুনে তাঁর জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে যায়। তিনি ঠিক করে ফেললেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীই হবেন নচেৎ কিচ্ছু না। প্রতিজ্ঞা করলেন যে যতোদিন মঞ্চে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত না গাইবেন ততোদিন চুল কাটবেন না। কিন্তু তাঁর মতো বিরল প্রতিভার অধিকারীকে কি আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়? দু বছর পর মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তিনি মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ পান। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সঙ্গীত তাঁর কাছে নিছক গান গাওয়া ছিল না... ছিল ঈশ্বরের আরাধনা। তাঁর কথায়.... "আমি কী দিয়েছি, কি দিইনি জানি না। মনে হয়, সবই তো তাঁরই (ঈশ্বরের) খেলা।”

গুজরাতের সানন্দ থেকে মেওয়াতি ঘরানার সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন যশরাজ। তিনি ছিলেন সুরসম্রাট। একবার ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি আমন্ত্রণ করলেন পণ্ডিত যশরাজকে। তখন ছিল মে মাস, রাত ছিল পূর্ণিমার, আকাশও পরিষ্কার। কিন্তু যশরাজের সেদিন খুব 'ধুলিয়া মালহার' গাইতে ইচ্ছা করছে। বৃষ্টি নামার আগে রে ধুলোর ঝড় হয়, তারপর বৃষ্টি নামে—তার সুর নিয়েই রাগ ‘ধুলিয়া মালহার’। যশরাজ গাইতে শুরু করলেন। ২০ মিনিটের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ধূলিঝড়, তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টি! মুগ্ধ, বিস্মিত বাজপেয়ি সেদিন যশরাজের নাম দিলেন ‘রসরাজ’।

পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ এবং পদ্মশ্রীর মত পুরস্কারের দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন পণ্ডিত যশরাজ। আশি বছর ধরে সংগীত জগতে কাজ করে গিয়েছিলেন। ভারত, কানাডা এবং আমেরিকায় তাঁর কাছে সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নিয়েছে অগণিত ছাত্র-ছাত্রী। সারা বিশ্বেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বললেই একবাক্যে উঠে আসত যশরাজের নাম।

সম্প্রতি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে আমেরিকার নিউজার্সিতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লকডাউনের কারণে আর ভারতে ফেরা হয়নি তাঁর। নব্বই বছর বয়সে আজ তিনি চলে গেলেন অচিন সুরলোকের আনন্দযজ্ঞে যোগ দিতে।
শেষ হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের এক সোনালি অধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...