ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এক দীর্ঘ, অনন্ত পথের মত। দেশের ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন পর্ব চলছে। একটা দীর্ঘ লড়াই পেরিয়ে আমাদের দেশ তবে এই দিন দেখতে পেয়েছে। নামী, অনামী অজস্র এমন মানুষের আত্মবলিদানের ফল আজকের স্বাধীনতা। কনকলতা বড়ুয়া তেমনই এক দুঃসাহসী বিপ্লবী ছিলেন। বীরাঙ্গনা এই নারী তাঁর মেয়েবেলা থেকেই ভালবাসতেন দেশকে। দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি জানতেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গ দিতে পারে সাহস আর অন্তরের শক্তি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন।
কনকলতা বড়ুয়ার জন্ম ১৯২৪ সালের ২২শে ডিসেম্বর। অসমের বনরাগবাড়ী গ্রামে জন্ম তাঁর। খুব অল্প বয়সে হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। ছোট্ট জীবনের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন দেশকে। স্বাধীন দেশের স্বপ্নই ছিল তাঁর সঙ্গী।
একেবারে শৈশবেই নিজের বাবা মাকে হারিয়েছিলেন কনকলতা। বড় হচ্ছিলেন দিদিমার কাছে। দিদিমা আদরে রাখতেন নাতনিকে। স্নেহ, ভালোবাসা, আগলে রাখা এই সবটুকুর মধ্যেও একটা অনুভূতি কাঁটার মতো খচখচ করত কনকলতার জীবনে। নিজের দেশের পরাধীনতা। তাই ছোট্ট কনকলতা একটা ব্রত নেয় জীবনে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং নিজের দেশকে স্বাধীন করা। শিশু কনকলতা যত বড় হতে থাকে একটা রোগ বাসা বাঁধতে থাকে কিশোরী মনে। রোগের নাম স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান ও দেশের জন্যে প্রাণ নিবেদন।
১৯৩১ সালের মে মাসে আসামের গেমেরি গ্রামে একটি সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। তখন কনকলতা বড়ুয়ার বয়স সাত বছর। কনকলতা বাড়ির সামনের উঠোনে খেলছিলেন। হঠাৎ দেখেন মামা বেরোচ্ছে বাড়ি থেকে। হাতে দেশের পতাকা। শিশু কনকলতা মামা দেবেন্দ্রনাথ এবং যদুরাম বসুর সঙ্গে সেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। চারিদিকে তখন অহমিয়া গান বাজছে। দেশাত্মবোধের গান। কনকলতার অন্তরে যে বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল সেদিন তা বৃক্ষ হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে।
ছোট বয়স থেকেই মামাদের সঙ্গে আন্দোলনের সকল বৈঠক এবং সভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করতেন কনকলতা। স্বাধীনতার পাঠ ও শিক্ষা অন্তরে গড়ে তুলছিল এক বিপ্লবী সত্তা।
১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট মুম্বাইয়ের কংগ্রেস অধিবেশনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সারাদেশে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অসমের শীর্ষ নেতারা মুম্বাই থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রেফতার হন। অসমের এক নেতা জ্যোতিপ্রসাদ আগারওয়াল তখন ওই অঞ্চলে সংগঠিত সমস্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন।
১৯৪২ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর, তেজপুরের আদালত চত্বর। অসমের নেতারা ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তেজপুরের আদালত চত্বরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। কনকলতার সপ্রতিভ, সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এই কর্মসূচিতে।
তেজপুর থেকে ৮২ মাইল দূরে গাহাপুর থানায় তেরঙা পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। কনকলতা বড়ুয়া সেখান থেকে তাঁর গন্তব্যের দিকে হাঁটা শুরু করে। থানার কাছাকাছি ছিল বিপ্লবীদের দল। আকাশে, বাতাসে তখন একটাই প্রতিধ্বনি। 'বন্দেমাতরম'। থানার পুলিশ অফিসার এলোপাথাড়ি লাঠি চালাতে শুরু করে বিপ্লবীদের ওপর। অস্ত্রহীন বিপ্লবীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। একজন পুলিশ অফিসার হুঙ্কার দেয়। ''আর এক পাও এগোলে তোমাদের ওপর গুলি ছোড়া হবে, কাউকে কোন রেয়াত করা হবে না।'' পুলিশ অফিসারের চিৎকারকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন নির্ভীক বিপ্লবীর বন্দেমাতরম ধ্বনি। ব্রিটিশ পুলিশ তবে একটুও জমি ছাড়তে রাজি ছিল না। গুলি চালানো শুরু হয়। কনকলতার বুকে এসে লাগে গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সতেরো বছরের কিশোরী। স্বাধীনতা আন্দোলনের যুদ্ধপথে নিবেদিত হয় আরেকটি প্রাণ। ওই দিন গুলিতে মারা গিয়েছিলেন আরেকজন বিপ্লবী। মুকুন্দ কাকোতি। দুজনের মৃত্যুর পরেও থামেনি গুলি। কনকলতার মরদেহ কাঁধে করে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে সফল হয়েছিলেন বিপ্লবীরা।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস অনেক বিপ্লবীকে সেভাবে জায়গা দেয়নি। কনকলতা বড়ুয়া তাঁদের মধ্যেই একজন। অসমে তাঁর নামে একটি উদ্যান রয়েছে। কনকলতার মত এমন সাহসী, নির্ভীক প্রাণের জন্য রইল অন্তরের শ্রদ্ধা।