‘বাংলার ঝাঁসি রানী’ বেলা মিত্র

সেনার উর্দিধারী টানটান শিরদাঁড়ার এক মেয়ে। প্রসন্ন মুখের হাসিটি দেখে এতটুকু বোঝার উপায় নেই শিরায় কতটা আগুন। এই একরোখা স্বভাবটা যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। সেই স্বভাবই বজায় ছিল াজীবন। দেশ তাঁকে চিনেছিল ‘বাংলার ঝাঁসি রানী’ নামে। তিনি বেলা বসু। চেনা নামে বেলা মিত্র।

তাঁর নামেই আজকের 'বেলানগর স্টেশন'। এই স্টেশনটি দেশের প্রথম মহিলা নামাঙ্কিত রেল স্টেশন। বিপ্লবী এবং সমাজকর্মী বেলা মিত্রের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৫৮ সালে ভারতীয় রেল মন্ত্রক হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের এক স্টেশনের নাম রাখা হয় বেলা নগর স্টেশন। হাওড়া জেলার বালি-জগাছা ব্লকে বেলানগরের অবস্থান।

বেলা বসু, অমিতা ওরফে বেলা মিত্রের জন্ম ১৯২০তে। ভাগলপুরে তাঁর মাতুলালয়ে। পিত্রালয় ২৪ পরগণা জেলার কোদালিয়ায়। পিতা সুরেশচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে কাকা।   

১৯৩৬-এ বিবাহ হয়ে যায় যশোরের হরিদাস মিত্রের সঙ্গে। বেলা দেবী বড় হয়ে উঠেছিলেন স্বদেশী ভাবনার পরিসরে। জীবনের শুরু থেকেই কাকা সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব ছিল গভীর। বেলা আর তাঁর ছোট বোন ইলা দুজনেই ছোট থেকে মুক্ত ভাবনায় বেড়ে উঠছিলেন। স্বদেশ, সমাজ আর মানুষ- এই তিনটি শব্দ মিশে গিয়েছিল জীবনের আদর্শে।

বিবাহের পরও বদল আসেনি সেই মানসিকতায়। পাশে পেয়েছিলেন সম আদর্শে বিশ্বাসী স্বামীকে। ঠিক দু’বছরের মাথায় বাড়িতেই গড়ে তুললেন এক নারী সংগঠন। বালিকা বয়স থেকেই চেয়েছিলেন সরাসরি দেশের মুক্তি যুদ্ধে যোগদান করবেন। সেই সুযোগের জন্য খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। নারী সংগঠন এবং সেই সূত্রে নিরন্তর মানুষের সঙ্গে যোগ তাঁকে মানসিকভাবে দৃঢ় এবং পরিণত করে তুলেছিল।

১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু রামগড়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশন ত্যাগ করে আপোস বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলে বেলা মিত্র তাঁর অনুগামী হন। ১৯৪২ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনী তৈরি হলে বেলা দেবী সেনাদলে সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। সঙ্গে স্বামী হরিদাস মিত্র।

১৯৪৪-এর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কলকাতার গোপন আস্তানা থেকে সিঙ্গাপুর-রেঙ্গুনে ট্রান্সমিটারে খবরের আদানপ্রদান, নিরাপদে বিপ্লবীদের নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া এমন সব বিপদজনক কাজের ভার ছিল তাঁর ওপর। বুদ্ধি আর সাহসের জোরে সফল হয়েছেন বারবার।

১৯৪৫-এ ২১ জন বিপ্লবীর সঙ্গে গ্রেফতার হতে হয় নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে। কিন্তু সেই ঘটনা এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি বেলা দেবীর মনোবলে। নিজের গহনা বিক্রি করে দেন বাহিনীর তহবিলের স্বার্থে। ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আজাদ হিন্দ ফৌজের অনেকের সঙ্গে হরিদাস মিত্রের ফাঁসির হুকুম দেওয়া হয়। সেই রায় মকুব করার আবেদন করেন গান্ধীজির কাছে।

১৯৪৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর গান্ধীজি চিঠি লেখেন বৃটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে। গান্ধীজি লিখেছিলেন, “যদি এই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়, তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল।”

গান্ধীজির আবেদনকে মান্যতা দিয়ে হরিদাস মিত্রসহ তিন দেশপ্রেমিকের ফাঁসির আদেশ বদলে যায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। পরবর্তী সময়ে স্বামী হরিদাস মিত্র জাতীয় কংগেসে যোগদান করেন। বিধান সভার ডেপুটি স্পিকার পদে আসীন হন। বেলা মিত্র রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।  

১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে বেলা দেবী নেতাজির আদর্শে গঠন করেন ‘ঝাঁসি রানি বাহিনী’। সর্বোচ্চ নেত্রী তিনি নিজেই। দেশ স্বাধীন হলেও শান্ত হতে পারেননি তিনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শরনার্থী পুনর্বাসনের কাজে। বালি সংলগ্ন অঞ্চলে। ডানকুনি অভয়নগর অঞ্চলে শিবির গড়ে তুলেছিলেন ঘরহারা মানুষদের জন্য।

নিরন্তর পরিশ্রমে এক সময় ভেঙে পড়ে শরীর। ১৯৫২’র জুলাইতে মাত্র ৩২ বছর বয়সে প্রয়াত হন ‘বাংলার ঝাঁসির রানী’ বেলা মিত্র।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...