কালীকথা: নবদ্বীপের আগমবাগেশ্বরী

আজকাল বইপাড়ায় তন্ত্র নিয়ে গপ্পো উপন্যাস লেখার ধুপ পড়েছে। তাই আগমবাগীশ নামটিও সবার চেনা। সেই আগমবাগীশের আরাধ্য দেবীই আজ আমাদের কালিকথায় স্থান পেয়েছেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রায় ৫০০ বছর আগে মাতৃসাধক কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশ এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। মনে করা হয়, আজ সর্বত্র পূজিতা যে দক্ষিণাকালী, তাঁর মাতৃমূর্তির রূপকার স্বয়ং আগমবাগীশ। ঘরে ঘরে বা বারোয়ারি মণ্ডপে আমরা এখন যে কালী পুজো করি সেটি আদি কালীর মূর্তি বা শাস্ত্র কল্পিত নয়। এক সময় অখণ্ড বঙ্গদেশে কালীপুজোর প্রচলন ছিল না। একমাত্র তন্ত্র সাধকেরা মাতৃ আরাধনা করতেন। তাও কালীযন্ত্র এবং ঘটেই চলত মাতৃ আরাধনা। শ্মশানে, বন-জঙ্গলে নির্জনে তন্ত্রমতে কালীপুজো হত। তখন তামার পাত্রে খোদাই করে বা মরার খুলিতে রক্ত দিয়ে এঁকে কালী পুজো করা হত। যা ছিল শক্তির নিরাকার সাধনা। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে কালীর আরাধনার সূচনা করেছিলেন আগমবাগীশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিকারার সাধনার মর্ম বোঝে না। তাই মূর্তি দরকার। তাঁকে নিয়ে দুটি মত রয়েছে, একটি তিনি শ্রীচৈতণ্য সমসাময়িক অপরটি তিনি চৈতণ্যের মৃত্যুর ৭০ বছর পরে তিনি জন্মেছিলেন। কিন্তু বঙ্গদেশে বর্তমান কালীমূর্তির রূপে যে তিনিই প্রচলন করেছিলেন তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। 
 
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন সপ্তদশ শতকের এক উচ্চস্তরের তন্ত্রসাধক। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নদিয়ার নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৬০০-১৬১০ সনের মধ্যে। তাঁর আসল নাম ছিল কৃষ্ণনন্দ ভট্টাচার্য্য, তবে তন্ত্র সাধনায় আগম পদ্ধতিতে সিদ্ধিলাভ করায় তিনি আগমবাগীশ উপাধী অর্জন করেন। বাংলায় শক্তিচর্চাও তখন বিক্ষিপ্ত ও অধোগামী। হাল ধরলেন তিনিই। আনুমানিক ১৭০টি তন্ত্রশাস্ত্র ও পুঁথি ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করে 'বৃহৎ তন্ত্রসার' গ্রন্থ রচনা করলেন। যা আজও বিভিন্ন পুজোর আধার হিসেবে গণ্য হয়। এই মহাসাধক বাংলায় ঘরে ঘরে কালীপুজোর প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।​ শোনা যায়, কোন একদিন মায়ের দর্শন পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন সাধক। মায়ের কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। প্রতিমা গড়ে মায়ের পুজো করার অনুমতি চান। এরজন্য প্রয়োজন কালীর মৃণ্ময়ী মূর্তি। কিন্তু কালীর ভয়াবহ রূপের পুজো কী করবেন সাধারণ গৃহীরা? চিন্তায় বিভোর তিনি। সেই রাতেই দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন যে ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে নারীমূর্তি তিনি দেখতে পাবেন, সে রূপই তৈরি করতে হবে মায়ের সাকার মূর্তি, ইষ্ট দেবীর মূর্তি। অর্থাৎ তাঁর আদলেই নির্মিত হবে কালীর মূর্তি। ব্যাস, পরদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছুটলেন গঙ্গাস্নানে। 
 
গায়ের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে চলেছেন কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশ। কিন্তু কোথাও কারও দেখা নেই। অস্থির তাঁর মন, এমন সময় আচমকাই গঙ্গা স্নান সেরে ফেরার পথে কৃষ্ণানন্দ এক কৃষ্ণবর্ণা গোয়ালিনকে দেখতে পান। তিনি গাছের গায়ে ঘুঁটে দিচ্ছিলেন। বাঁ-হাতে ধরা গোবরের তাল। পরণের কাপড় হাঁটুর উপরে। কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে সিঁদুর ঘেঁটে গিয়েছে। গায়ের রং কালো, শরীরে আলুথালু একটি ছোট কাপড়, কপালভর্তি সিঁদুর, হাঁটু পর্যন্ত কুঞ্চিত ঘন কালো কেশ। কাজের খেয়ালে তাঁর গায়ের কাপড় কিছুটা সরে এসেছে বক্ষস্থান থেকে। ফলে শরীরের উপরিস্থল কার্যত বিবস্ত্র। ওই বধূকে দেখে কৃষ্ণানন্দ দাঁড়িয়ে পড়েন। তাঁর মনে পড়ে যায় রাতের স্বপ্নের কথা। তখন হঠাৎ সেই গায়ের বধূ পিছনে তাকিয়ে কৃষ্ণানন্দকে দেখে অবাক হয়ে যান। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং মহাপণ্ডিত কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশ। এ অবস্থায় পরপুরুষ কৃষ্ণানন্দকে দেখেই বধূ লজ্জায় জিভ কেটে ফেলেন, সে সময় তাঁর ডান পা অগ্রে প্রসারিত ছিল। সেই সময় কৃষ্ণনন্দ লক্ষ্য করেন ওই কৃষ্ণবর্ণ বধূর চোখদুটি ভীষণ উজ্জ্বল, মুখে চোখে বিন্দু বিন্দু ঘাম এবং কপাল সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে গেছে।
 
কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশ ওই বধূর মধ্যেই জগজ্জননী মাতৃরূপে দেখতে পেলেন মঙ্গলময়ী কালীকে। প্রথম ভাবনাতেই নির্মিত হল প্রথম কালীমূর্তি। এই কৃষ্ণবর্ণার রূপ গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি করে মাতৃমূর্তি গড়েন কৃষ্ণানন্দ। পরে তাতে আরও কল্পনা মিশিয়ে আগমবাগীশ প্রথমবার কালীমূর্তির রূপ দান করলেন। ওই গ্রাম্য বধূর মতোই কালী কৃষ্ণবর্ণা, লম্বা কেশ। গোবরের তাল ধরা বাম হাত হল বরাভয় মুদ্রা এবং ডান হাতে গোবরের ছড়া দিয়ে ঘুটে দেওয়ার ভঙ্গিতেই বসিয়ে দিলেন খড়গ। এরপর তাঁর প্রচেষ্টা এবং আন্তরিকতায় সেই করালবদনা ভয়ংকরী রক্তলিপ্ত শ্মশানচারিণী দেবীকে মঙ্গলময়ী শান্ত দক্ষিণা কালী রূপে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলার ঘরে ঘরে। এই রূপই পরবর্তীতে পূজিত হয়ে আসছেন মা কালীকা। কৃষ্ণানন্দ একই দিনে মূর্তি গড়ে পুজো করতেন এবং পরের দিন ভোরে বিসর্জন দিতেন। 
 
এখন অবশ্য রীতি বদলে গিয়েছে, দেবীপক্ষের একাদশী তিথিতে আগমবাগীশের মৃণ্ময়ী মাতৃমূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায় মায়ের চক্ষুদান হয়। আনুমানিক ৫০০ বছর ধরে নবদ্বীপের আগমেশ্বরী পাড়া কালীবাড়িতে ওই পুজো হচ্ছে। প্রাচীন রীতি মেনে আজও পুজো হয়। নদিয়া জেলার নবদ্বীপের সুপ্রাচীন ও বিখ্যাত কালী পুজোগুলির অন্যতম আগমেশ্বরী পাড়ার কালীবাড়ির পুজো। মা এখানে দক্ষিণাকালী রূপে পূজিতা হন। এই মন্দিরে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। তবু কালী পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় মতে, তাই এখানে কোনরকম বলি হয় না। কারণবারিরও ব্যবহার নেই তাঁর পুজোয়। শাক্ত আর বৈষ্ণব মন্ত্রের এক মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। মূল মন্দিরের বাইরে সুবিশাল মাতৃমূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয়। পুজো শেষ হলে, একাধিক বাহক মাকে কাঁধে বহন করে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় পীরতলা খালে বিসর্জন দেয়। 
    
আগমসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দের মূর্তিই "রীঁ মাতা আগমেশ্বরী" নামে খ্যাত। এটি কিন্তু পারিবারিক পুজো। কালীপুজোর দিন সারাদিন ব্যাপী নবদ্বীপের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হন মণ্ডপে। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...