উনবিংশ শতকের কলকাতা। এসপ্ল্যানেড-এর একটা বইয়ের দোকান। থরে থরে বই সাজানো। এক ব্রিটিশ সাহেবের বইয়ের দোকান ছিল এটি। সে সময়ে বইপ্রেমীদের তীর্থক্ষেত্র ছিল এই দোকান। নানা ভাষায় বই পাওয়া যেত এখানে। দেশী বা বিদেশী সব রকম বই পাওয়া যেত। একদিন এক সুপুরুষ এসেছেন বই কিনতে। সৌম্যকান্তি চেহারা। নেড়েচেড়ে দেখছেন নানা বই। বই তাঁর কাছে ছিল সমুদ্রের মতো। কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনবেন কিছুতেই ভেবে পান না। বই যে তাঁর পরম আত্মীয়। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এসপ্ল্যানেডের এই বিশেষ দোকানে মাঝেমাঝেই আসতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বই বাছাই এবং কেনার জন্য অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল এটি তাঁর।
একদিন দুপুরে নিয়মমাফিক বই কিনতে এসেছেন এখানে। বই নেড়েচেড়ে দেখছেন এমন সময় এক দীর্ঘকায় যুবক এসে হঠাৎ করে তাঁকে প্রণাম করল। খানিকটা অবাক হলেন বিদ্যাসাগর। তবে সেই ছেলের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই বিস্ময়ের ঘোর কাটল। মুখ দেখেই চিনতে পেরেছিলেন সেই ছেলেকে। তবুও জানতে চাইলেন- "তুমি গঙ্গা ডাক্তারের ছেলে না? আশু তাই তো? বই কিনবে? কী বই কিনবে কিছু ভেবেছ?''
সেই ছেলেটির মাথায় তখন হাজারো বইয়ের নাম আঁকিবুকি কাটছে। বই তো সে কিনবেই, কিন্তু একটা বা দুটো নির্দিষ্ট নাম বলে কী করে? তাই আমতা-আমতা করছিল সেই যুবক।
যুবকের ভেতরের অস্বস্তি ছাপিয়ে তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল আলো। জ্ঞান আহরণের ইচ্ছের আলো। সেই আলোয় আলোকিত যুবককে সেদিন বিদ্যাসাগর উপহার দিয়েছিলেন একটা বই। ড্যানিয়েল ডিফোর লেখা কালজয়ী বই ‘রবিনসন ক্রুশো’। সেই বই তখন ওই যুবকের চোখে-মুখে রামধনু এঁকে দিয়েছে। যুবকের নাম আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর চোখেমুখে লেগে থাকা উজ্জ্বল এই রামধনু চোখ এড়ায়নি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন “ মন দিয়ে পড়বে এ বই”।
কথা রেখেছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।এই বইয়ের মূল উপজীব্য ছিল লড়াই। বেঁচে থাকার আর্তি। একজন মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে একাকী একটি দ্বীপে বেঁচে থাকার চেষ্টা উদ্বুদ্ধ করেছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে।
এমনই বইপ্রেমী মানুষ ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুব ছোট থেকেই বইপাড়ায় যাতায়াত ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। সঙ্গী ছিল বই কেনার অভ্যাস। তিনি মনে করতেন বই পড়া আর বই কেনা এই দুটোই গায়ে গায়ে লেগে থাকা অভ্যেস।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। তবে সাধারণ, গৃহী মানুষের ডায়েরির মত খরচ খরচা হিসেবেও তোলা থাকতো সুন্দর করে। ছেলের জন্যে মূল খরচের জায়গায় থাকত বইয়ের খাতে খরচ।
তবে এই সাহসী বইপ্রেমী কিন্তু মোটেই স্কুল যেতে চাইতেন না। নিভৃতে বাড়িতে বসে বই পড়াকে সাধনার মত করে দেখতেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাই স্কুলের গোলমাল, চেঁচামেচিকে তাঁর যাত্রাপালার মতো মনে হতো।
তবেই এই গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাবা সকালে উঠে বই পড়ার অভ্যাস করিয়েছিলেন ছেলেকে। সকালে উঠে বাবার সঙ্গে খানিকটা বেরিয়ে এসে নিয়মিত বই নিয়ে বসতেন। সে বই গতানুগতিক পড়ার বই নয়। শিক্ষা, ভালোবাসা, জানার ইচ্ছা সবমিলিয়ে সেই বইয়ে থাকতো জ্ঞানের সমুদ্র।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজেও ডায়েরি লিখতেন। পরে গবেষণা করে দেখা গেছে তাঁর ডায়েরির পাতায় নিজের কোন দিনলিপি নেই, পাতা ভরা থাকত বইয়ের নানা চ্যাপ্টারের বিবরণে। কোন দিন কী বই তিনি পড়েছেন এবং সেখান থেকে কতটুকু আত্তীকরণ করেছেন নিজের মধ্যে তারই বর্ণনা লেখা থাকত ডায়েরিতে। এমনকি কে কেমন ভাবে পড়াতো, অর্থাৎ কোন শিক্ষকের পড়ানো যদি মনের মত না হত তার উল্লেখও থাকতো সেই জায়েরী জুড়ে। বই পড়াই ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সাধনা। এককথায় অবসেশন।
রীতিমতো হিসেব কষতেন কদিনে একটা বই শেষ করছেন, বা কদিনে কটা বই শেষ করতে পারছেন, তারও হিসেব কষতেন নিয়মিত। একবার অসুস্থ হওয়ায় তাঁক বাবা তাঁকে ব্যারাকপুরে পাঠিয়েছিলেন। গঙ্গাতীরের একটি বাড়িতে থেকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য। সেখান থেকে বাবাকে রোজ চিঠি লিখতেন। না নিজের স্বাস্থ্য কতটা উন্নত হল বা আদৌ রোগ সারছে কিনা, তার উল্লেখ থাকতো না। মূলত সেখানে থাকত পড়াশোনার কথা। স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় মিল্টনের 'প্যারাডাইস লস্ট'-এর প্রথম পরিচ্ছেদ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। যা সেই সময়ে এফ. এ ক্লাসের পাঠ্য ছিল।
একবার একটা অংকের বই বড় পছন্দ হয়েছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। সেই বইয়ে থাকা সব অংক তিনি কষে দেখবেন এই ছিল ইচ্ছে। কিন্তু সেই বই ছিল ফরাসি ভাষায় লেখা। তাই সহজ ছিল না সেখান থেকে অংক করা। কিন্তু বইপ্রেমী এই মানুষটি হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। অংক করার জন্য শিখে নিয়েছিলেন ফরাসি ভাষা।
বই পড়ার ব্যাপারে যতটা উৎসাহী ছিলেন তিনি, তেমনি আগ্রহী ছিলেন বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে। বাবার সঙ্গে কলকাতার বিখ্যাত বইয়ের দোকানগুলোয় তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ছেলেবেলায় বাবার নামে ধারেই বই কিনতেন। মাঝে মাঝে তাঁর বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সেই ধার শোধ করতে গিয়ে চমকে উঠতেন। ১৮৮০ সালে এন্ট্রান্স পাস করেছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ১৮৮১ সালে তাঁর বই কেনার খরচ ছিল ৪৭৬১ টাকা। তার ঠিক আট বছর পরে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২১,১৬০ টাকা।
নিলামঘরেও যেতেন পুরনো বই কিনতে। জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড-এর মত দেশের প্রকাশকদের সঙ্গেও রীতিমত যোগাযোগ ছিল তাঁর। গবেষণা করে দেখা গেছে সারা জীবনে তিনি নাকি পাঁচ লক্ষ টাকারও বেশি বইপত্র কিনেছেন। জাতীয় গ্রন্থাগারের একটি বিশেষ বিভাগ রয়েছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সংগৃহীত বই নিয়ে। এখানে বইপত্রের সংখ্যা প্রায় ৮৫ হাজার। আইন, গণিত, ইংরেজি, সাহিত্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, জীবনী গ্রন্থ সব বিভাগেরই বই রয়েছে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নিজের বাড়ির তিনতলাটাও ছিল লাইব্রেরী। তাঁর পুত্র উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় বারবার উঠে এসেছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বই-যাপনের কথা।
এছাড়া শুধু বই পড়াই কি সব? এই যে বই পড়ার ইচ্ছে পর্যন্ত যে মানুষগুলো শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেয়! তাঁদের কথা কতটা মনে রাখে ছাত্রছাত্রীরা? আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সেই মানুষ অর্থাৎ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হয়ে সব সময় লড়াই করেছেন। তাঁদের সঠিক বেতন দেওয়া, তাঁদের মর্যাদা, চাকরির স্তর সবকিছু নিয়েই রীতিমতো প্রশ্ন করেছেন ব্রিটিশ সাহেবদের। কখনো আপোস করেননি শিক্ষার ক্ষেত্রে।
এই গুণী মানুষটির সৃষ্টি আজও রয়ে গেছে অমলিনভাবে। আর তাঁর সংগৃহীত ও লেখা বই এখনো আলো দেয় অজস্র শিক্ষার্থীকে। সূর্যের আলোর মত ঝলমল করে তাঁর সৃষ্টিরা। আজ বিশ্ব বই দিবসে এই বইপ্রেমী মানুষটির কথা চর্চা করা বিশেষ প্রয়োজন।