মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ পরাজিত হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্যে পরবর্তী নবাব হলেন মীরজাফর। তিনি লর্ড ক্লাইভের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাংলার কয়েকটি অঞ্চল। তার মধ্যেই ছিল বসিরহাট এবং সেই থেকে বসিরহাট একটি মহকুমা হিসেবে চিহ্নিত হয়। নুন ব্যবসার এক জমজমাট কেন্দ্র হয়ে ওঠে বসিরহাট। মূলত ইছামতী নদী ওই অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। তখন নুন তৈরি হত ইছামতির জল থেকে এবং পাশের বাগুন্ডি গ্রামে ইংরেজ কোম্পানি ব্যবসার সুবিধার্থে ‘সল্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট’ অফিস গড়ে তোলে। আশ্চর্যের বিষয় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ-কর্তার পদ দিয়ে। তাঁর প্রথম পোস্টিং ছিল সেই বাগুন্ডি। কলকাতার বরানগর ঘাট থেকে ইছামতী দিয়ে তিনি সেখানে যেতেন। থাকতেন টাকির জমিদার মুন্সি কালীনাথ রায়চৌধুরীর বাড়িতে। তিনি টাকির শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসারের অন্যতম ধারক বাহক ও বটে।
ব্রিটিশ আমলেই ১৮১০ সালে বসিরহাটে নীলের ব্যবসাও শুরু হয়। একই সঙ্গে নীল আর নুনের ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইছামতীর দু’ধারে নীলকুঠি তৈরি হয়। ১৮৪০ সালে এই নদীর ধারে হাট শুরু হয়। নদীপথেই পণ্য সরবরাহ করা হত। বসিরহাটের পুরোনো বাজার চালু হয় ১৯০০ সালে। আর ১৯২২ সালে নতুন বাজারের পথ চলা শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে বসিরহাট হয়ে উঠেছিল কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র।
বসিরহাটের নামকরণের ইতিহাস অতি প্রাচীন হলেও তা নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর। কেউ বলেন, ডক ঘাটের ইজারাদার বসু পরিবারের থেকে ‘বসুর হাট’ অথবা ‘বসুদের হাট’ কথাটি এসেছে। পরে সেটাই হয়ে গেছে ‘বসিরহাট’। কারো কারো মতে, ‘বসি’ মানে ‘নিচু জমি’। সেখান থেকেই এসেছে ‘বসিরহাট’ নামটা। আবার ‘বশি’ মানে নুন। বসিরহাটে যে একটা সময়ে নুনের বাণিজ্য চলত তার থেকেও নামকরণ হতে পারে। কিছু লোক বলেন, বাঁশের হাট থেকে এরকম নাম হয়েছে। ‘বসতি’ থেকেও বসিরহাট নামটা আসতে পারে, এই সম্ভাবনার কথাও বলেছেন কিছু মানুষ। ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে, ‘বশী’ নামের কোনো ব্যক্তির থেকে জায়গার নাম হয়েছে। তাঁর মতে, ‘বশী’ শব্দের অর্থ হল ‘স্বাধীন’, ‘স্বতন্ত্র’। ওই যুক্তিকে অনুসরণ করেই, বসিরহাটে এক সময়ে করমুক্ত স্বাধীন বাণিজ্য চলত বলে এই ধরনের নামকরণ হয়েছে। আবার একটা প্রচলিত কথা হল, বসির মহম্মদ বা বসির খানের থেকে গোটা অঞ্চলের নাম হয়েছে বসিরহাট। মধ্যযুগে এখানে বসিরের নামে হাট বসত বলে একটা মত চালু আছে। ভারত স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সীমান্তের একটি মহকুমা অঞ্চল ও শহর হিসেবে বসিরহাট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।