শ্রীরামকৃষ্ণ বসে রয়েছেন ধ্যানে। রানী রাসমনির জামাই মথুরবাবু বেশ বিমর্ষ। ধ্যান শেষে রামকৃষ্ণের চোখ এড়ালো না মথুরবাবুর ম্লান মুখ। জিজ্ঞেস করলেন "কী হয়েছে?"।
সেদিন ছিল নবমী নিশি। মায়ের বিদায় কেউই চায় না। মথুর বাবু নিজের মনের কথা জানালেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। তিনি জানালেন মায়ের বিদায়ের জন্যে মন খারাপ তাঁর। মথুরচন্দ্রের মন খারাপের কারণ শুনে শ্রী রামকৃষ্ণ স্মিত হাসলেন। বললেন "মায়ের বিসর্জনে মন খারাপ? মায়ের কি বিসর্জন হয়? মাকে বিসর্জন দেবে কোথায়? বিসর্জন দেবে নিজে নিজের হৃদয়ে।" শ্রীরামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন সাকার দেবী মূর্তির বিসর্জন হয় দশমীর দিন। কিন্তু যে মা অন্তরে অধিষ্ঠান করেন শুভ চিন্তার উৎস হয়ে, সেই মায়ের বিসর্জন হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরচন্দ্রকে বুঝিয়েছিলেন বিজয়ের অর্থ মা ও সন্তানের মধ্যে দূরত্ব নয়। মা কোথাও চলে যান না। বরং এই কটা দিন সন্তানের সঙ্গে নিবিড় ভাবে কাটিয়ে প্রকৃত অর্থে অধিষ্ঠান করতে যান সন্তানের হৃদয়ে। তাই বিচ্ছেদের দুঃখ আসলে মাকে আর সন্তানকে আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে।
শোনা যায় একবার নাকি বিজয়া দশমীর দিনে মথুরবাবু শ্রীরামকৃষ্ণ দেব কে বলেছিলেন প্রাণ থাকতে তিনি দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দিতে পারবেন না। এটা শুনেই শ্রীরামকৃষ্ণ দেব আশ্বস্ত করেছিলেন মধুর চন্দ্রকে। মথুর চন্দ্র বলেছিলেন "মা কে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না।"
শ্রীরামকৃষ্ণ তখন হেসে বলেছিলেন "ওহ! এই তোমার ভয়? তা মাকে ছেড়ে তোমায় থাকতে হবেই বা কেন? আর মাই বা সন্তানকে ছেড়ে থাকবেন কেমন করে? আসলে এই চারটে দিন মা বাইরে বসে আমাদের পুজো নেন। বিসর্জন এর পর থেকে তিনি জেগে থাকবেন আমাদের অন্তরে। তাঁর মূর্তি বিসর্জন দাও নিজের হৃদয়ে। " মন শান্ত হয়েছিল মথুরচন্দ্রের।
আমাদের শাস্ত্রেও বলা আছে, যিনি নিরাকার দেবতা সেই সাকার মা দুর্গাই মর্ত্যে পুজো গ্রহণ করেন।। পুজো শেষে তিনি ফিরে যান আবার তার নিরাকার রূপে। আসলে তখন বিসর্জন হয় না। মা ফিরে যান সন্তানের হৃদয়ে। যে দেবীমূর্তি জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সে আসলে আমাদের সারা বছরের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, অভিমানের প্রতিরূপ। বিজয়া আসলে অন্তরে আলো জ্বলে ওঠার প্রতীক।
বিসর্জন শেষে অবসান হয় সেই সকল অভিমানী অনুভূতির। তারপর মা অধিষ্ঠান করেন ভক্তের হৃদয়ে। বিসর্জনের এমন ব্যাখ্যাই দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
তবে পুরাণ মতে বিজয়া দশমীর অন্য ব্যাখা রয়েছে। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষ দশমী তিথিতে দেবী ফিরে যান নিজের বাড়িতে। বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি ফিরে যান দেবী। তাই একে দশমী বলা হয়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশী তে দেবী দুর্গা আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং টানা নদিন, নরাত ধরে তিনি মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধের পর দশমীর দিনেই তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। অর্থাৎ দশমীর দিনেই দেবী দুর্গা জয়লাভ করেছিলেন মহিষাসুরকে বধ করে। তাই এই দিনটি বিজয়া দশমী হিসেবে পালিত হয়। তবে এই বিজয় দশমীর সঙ্গে কিন্তু দেবীর ষষ্ঠীতে বোধনের কোন সম্পর্ক নেই।
রামায়ণ ও মহাভারতেও দেবীর বিজয় দশমী নিয়ে আলাদা কাহিনী বর্ণিত আছে। রামচন্দ্র দেবীর বোধন করেছিলেন শরৎকালে। ১০৮টি পদ্ম ফুল দিয়ে তিনি দেবীর বোধন করেন। ওই সময়টা দুর্গাপুজোর জন্যে নির্দিষ্ট করা ছিল না। তাই একে অকাল বোধন বলে। আমাদের ষষ্ঠীর বোধন এই অকাল বোধনের অংশ। তবে বিজয় দশমী আসলে আলোর জয়ের উদযাপন। আবার এই দশমীতে আমরা আমাদের অন্তরের সকল গ্লানি, অন্ধকারকে ভাসিয়ে দিই। তারপর অপেক্ষা করে থাকি পরের বছর আবার এই আলোর উদযাপনের।