শিব পার্বতীর সন্তান দেবসেনাপতি কার্তিকের ছয় মাথার পিছনে আছে ছয় মাতার ইতিহাস!

শিব পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হলে উভয়ে কৈলাসে সুখে বাস করতে  লাগলেন। একবার দেবতারা কৈলাসে শিবের বাসভবনের সামনে বিষন্ন মুখে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলেন যে, আমাদের দুঃখ চিরকালের মতো দূর করার জন্য মহাত্মা শিব কোনো চেষ্টাই করছেন না। তিনি তারকাসুর বধের জন্য পার্বতীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলেন না। শিব কেন এখনও পর্যন্ত দেব কার্য সাধনে তৎপর হচ্ছেন না? সেই তত্ত্ব জানার জন্য অগ্নিদেবকে শিবের কাছে পাঠালেন দেবগন! অগ্নি তখন কপোতরূপে আশ্রমের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

শিবপুরাণ অনুযায়ী  অগ্নি যখন আশ্রমের মধ্যে কপোত রূপে প্রবেশ করলেন। শিব তখন সঙ্গমে রত ছিলেন‌। কপোতরূপধারী অগ্নিকে মহাদেব জন্মবীজ ধারণ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সেই জন্মবীজ চঞ্চুতে ধারণ করতে অসমর্থ হলেন অগ্নি। বাইরে গিয়ে সেই শিবতেজ  সহ্য করতে না পেরে তা গঙ্গায় নিক্ষেপ করলেন। গঙ্গাও তা সহ্য করতে না পেরে শরবনে নিক্ষেপ করলেন। সেই শরবনে তৎক্ষণাৎ সুন্দর দর্শন এক দেবশিশু জন্মগ্রহণ করল।

সেই সময় ৬ জন রাজ কন্যা স্নান করতে সেখানে এলেন তারা সেই দেবশিশুকে দেখে 'এই শিশু আমার' 'এই শিশু আমার' বলে স্নেহ ভরে কোলে নিতে গেলেন তখন সেই কুমার ছয়টি মুখ উৎপন্ন করে সেই ছয় রাজকন্যার স্তন্যপান করতে লাগলেন‌‌। সেই থেকে সেই শিশু মহাত্মা শরজন্ম 'ষাণ্মাতুর' নামে কীর্তিত হন। তার প্রথম নাম পার্বতী নন্দন। দ্বিতীয় নাম অগ্নিভূ, পরে তার নাম হল স্কন্দ। তারপর গঙ্গা পুত্র, তারপর শরজন্ম ও ষাণ্মাতুর নাম হল। এইভাবে তার বহু নাম হল। তারপর সেই রাজকন্যাগণ কুমারকে পুত্ররূপে গ্রহণ করলেন। দেবগণ নারদের মুখে এই কথা শুনে দেবাদিদেব মহাদেবের অনুমতি নিয়ে কুমার স্কন্দকে দেবসেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলেন। তারপর দেবগণ দেব সেনাপতি স্কন্দ ও দেব সেনাদের নিয়ে শোণিতপুরে গমন করলেন। সেখানে দৈত্যপতি তারক ও তার অসুর সৈন্যদের সঙ্গে দেব তাদের দশ দিন যুদ্ধ চলল। পরে দেব সেনাপতি স্কন্দ দৈত্য পতি তারককে এক অব্যর্থ শরাঘাতে নিধন করলেন এবং বহু অসুর সৈন্য নিহত হল।"

তারকাসুরের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাকি যে সকল অসুরেরা ছিল তারাও  প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পাতালে পালিয়ে গেল। এরপর দেবগণ দেব-সেনাপতি কার্তিককে সঙ্গে করে কৈলাসে শিবের কাছে চলে গেলেন। তারপর তারা মহাদেবের সামনে কার্তিককে বসিয়ে মহাদেবের মাহাত্ম্য কথা ও স্তুতি করতে শুরু করলেন। তারা দেবাদিদেব কে প্রসন্ন করতে সেখানে অবস্থান করে শিবের স্তব করতে শুরু করলেন।

দেবগণ সকলে মিলে বলতে লাগলেন, “হে ভক্তগণের অভয়প্রদ, দেবাদিদেব মহাদেব! আপনার প্রভাবাদি কী, স্বরূপ কী, কী আপনার গতি তার কিছুই আমরা অবগত নই। হে বিশ্বেশ্বর , আপনি যিনিই হন না কেন, আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দেব, আপনাকে নমস্কার। যিনি ভূত, যিনি ভব, যিনি ভব্য, যিনি চতুর্দশ ভুবন, যিনি চতুর্দশ ভুবনের নিমিত্ত উদ্ভূত হয়ে ' উদ্ভব ' নাম ধারণ করেন। তাঁকে নমস্কার। যিনি সংহার কর্তা, যিনি গঙ্গা- সলিল ধারক, যিনি সবকিছুর আধার এবং অব্যয়, তাঁকে আমরা নমস্কার করি। হে ভগবন, ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এবং যা স্থাবর ও জঙ্গম, সেই সকল জগৎ আপনার দেহ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। হে দেব, আপনি সবকিছুকে পালন করছেন এবং সংহার করছেন। আপনি পরম মঙ্গলময়। অতএব হে ভগবন, আপনি প্রসন্ন হয়ে আপনার শরণার্থী এই দেবগণকে অভয় দান করুন। এরপর ঋষিগণ বললেন, হে ত্রিশূলধারী, আপনি দিগম্বর, আপনিই কৃতান্ত, আপনিই বিকট, আপনি করাল। আপনি সরূপ, আপনি অরূপ, আপনিই বিশ্বরূপ। আপনাকে আমরা নমস্কার করি। আপনি দেবগণের মধ্যে ব্রহ্মার স্বরূপ, রুদ্রের মধ্যে নীললোহিত, সর্বভূতের মধ্যে সাংখ্যপুরুষ আত্মা। হে মহেশ্বর, আপনি লোকহিতের জন্য পঞ্চভূতকে সৃষ্টি করেছেন। আপনি আজ্ঞা করুন , আপনি যা বলবেন তাই করতে প্রস্তুত আছি আমরা।" এইভাবে  দেবগণ ও ঋষিগণ শিবের স্তব করে কার্তিককে সামনে বসিয়ে হাতজোড় করে দেবাদিদেবের সামনে অবস্থান করতে লাগলেন। দেবগণ ও ঋষিগণের স্তবে তুষ্ট হলেন মহাদেব। তিনি প্রসন্ন হয়ে বললেন, " হে দেবগণ , হে সপ্তঋষিগণ , যখনই তোমাদের কোন দুঃখ বা বিপদ উপস্থিত হবে তখনই আমার নিকট এসে আমার ভজনা করতে থাকবে।"দেবাদিদেব শিব এইভাবে আদেশ করলে দেবগণ ও ঋষিগণ মহাদেবকে প্রণাম করে নিজেদের নিজেদের জায়গায় চলে‌ গেলেন।

উল্লেখ্য এই অধ্যায়টি শিব পুরাণের ভারতীয় জীবনধারায় শিব চেতনা ও জ্ঞান সংহিতার অন্তর্গত নবম অধ্যায়ের 'কার্তিকের জন্ম,তারকাসুর বধ' অধ্যায়ে পাওয়া যায়।

এই অধ্যায়কে আমরা দুইভাবে গ্রহণ করতে পারি-১।শৈব মতে শিবই সব। তিনি আদি তিনি অন্ত। তিনি প্রলয় তিনি সৃষ্টি। শিবই মহাকাল তিনি কালকে ধারণ করে আছেন। তাই তার ভজনা করলেই সাক্ষাৎ মুক্তি।

২। অন্যদিকে বৈষ্ণব মতে শিব পরম বৈষ্ণব,নারদ অপেক্ষা ও ভগবানের শ্রেষ্ঠ ভক্ত তাই পতিতপাবন ভগবান নারায়ণের কৃপা পেতে হলে তার করুণা প্রাপ্ত হতে গেলে আগে ভগবানের শ্রেষ্ঠ ভক্ত মহাদেবের শরণাপন্ন হতে হবে। হর কৃপা করলেই হরিকে পাওয়ার রাস্তা মিলবে। তাই দুই মতেই উপরিউক্ত শিব স্তব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন বিষয়ে মনোগ্রাহী ফিচার আর্টিকেলের জন্য আপনার ঠিকানা www.jiyobangla.com

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...