নিজের শরীর থেকে নামিয়েছেন একের পর এক ঝুরি

বয়স তো কম হয় নি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের। কবে সেই ইংরেজ আমলে জন্ম। অবাক হচ্ছেন? কী ভাবছেন, গালগল্প? না মশাই না। সত্যি কথাই বলছি। ভদ্রলোকের বয়স... এই কম বেশি দুশো ষাট... বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? চলুন আমার সঙ্গে। হাতে হাতে থুড়ি লিখে লিখে প্রমাণ দিয়ে দিচ্ছি।

ভদ্রলোক? নাকি ভদ্রমহিলা? তাঁর ছেলেপুলে, নাতি নাতনি, তাদের ও নাতি নাতনি সবাইকে নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দাঁড়িয়ে কেন? কারণ তিনি যে হাঁটাচলা করতে পারেন না। একজায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি জন্ম দিয়ে গেছেন তাঁর অসংখ্য সন্তান সন্ততির.... অর্থাৎ তাঁর শরীর থেকে নামিয়েছেন একের পর এক ঝুরি বা শাখামূল। এবার বুঝতে পারছেন তো কার কথা বলছি? ইনি হচ্ছেন আমাদের শিবপুর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেই বিখ্যাত মহাবটবৃক্ষ বা "দ্য গ্ৰেট ব্যানিয়ন ট্রি" অফ বোটানিক্স।

আসুন, এবার একটু জেনে নিই আমাদের এই অতিবৃদ্ধ বৃক্ষপ্রপিতামহ অথবা প্রপিতামহীর ইতিহাস। ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ কর্ণেল রবার্ট কিড হাওড়ার শিবপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন যার বর্তমান নাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন, যাকে আমরা মুখে মুখে বি গার্ডেন বলতেই অভ্যস্ত। এই উদ্যান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় উদ্ভিদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো এবং বিভিন্ন বিদেশী উদ্ভিদকে এই দেশের আবহাওয়ায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। মোটামুটিভাবে চোদ্দোশো প্রজাতির সতেরো হাজার গাছের এই উদ্যানের মূল আকর্ষণ হলো "দ্য গ্ৰেট ব্যানিয়ন" বা "মহাবট"..

বি গার্ডেন তৈরি হওয়ার পর যখন এই বটগাছটি আবিষ্কৃত হলো তখনই তার বয়স বছর পঁচিশ। ১৮৫০ সালে যখন সেন্সাস হয় তখন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল এই বট তার উননব্বইটি ঝুরি বা শাখামূল নামিয়ে ফেলেছে। আর এই ছানাপোনা অর্থাৎ ঝুরিমূল বা স্তম্ভমূলগুলি মাটিতে প্রবেশ করে এই মহাবটকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর এতো আত্মীয়-স্বজন শুদ্ধু এই বট-দাদা বা বট-দিদির পরিধি হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৪০ মিটার। খুব স্বাভাবিকভাবেই তখন থেকেই মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে শুরু এই বটগাছটি। সে ও মহা সুখে বাড়তে থাকলো। কিন্তু তার এতো নিশ্চিন্তে সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠাটা বোধহয় প্রকৃতির সহ্য হলো না। ১৮৮৪ আর ১৮৮৭ সালে হলো ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আর সেই ঝড়েই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো এই বট। ছত্রাকের আক্রমণে এমন অবস্থা হয় যে মূল শিকড়কে কেটে বাদ না দিলে বাঁচানো যেতো না এই স্যার বা ম্যাডাম মহাবটকে। সেইমতো ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে কেটে ফেলা হলো গাছের কিছুটা অংশ। কিন্তু বাকি শাখামূলগুলো ভারি শক্তপোক্ত হয়ে এই বটকে একটা "দ্রুম" বা "মহাবৃক্ষে" পরিনত করলো। বর্তমানে ১৪,৫০০ বর্গ মিটার জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ২৪.৫  মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই গ্ৰেট ব্যানিয়ন যেন নিজেই একটি অরণ্য।সাতাশি প্রজাতির পাখি, অসংখ্য কাঠবিড়ালি এবং জানা অজানা বহু কীট পতঙ্গের আশ্রয়স্থল এই মহাবট। এই গাছ যতোটা জায়গা জুড়ে তার বিস্তার বাড়িয়েছে তা একটা ক্রিকেট মাঠের সমান। বিস্তৃতির দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশালাকার এই বটগাছটি যেভাবে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায়  প্রকৃতিকে সহায়তা করে চলেছে তা নিয়ে লিখলেই হয়তো হাজার পাতার একটা প্রবন্ধ হয়ে যাবে। একসঙ্গে দশ হাজার মানুষ দাঁড়াতে পারে এই গাছের তলায়.. এতোটাই বড়ো সে। গিনেস বুকে নাম ওঠে তার..মহাবটবৃক্ষ। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার  একটি পোস্ট স্ট্যাম্প ও চালু করে এই বটগাছটির ছবিসহ যেটা বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার এনভেলপের উপর লাগানো হয়।

কত ঝড়ঝাপটা সহ্য করেছে সে। আয়লা ফণী ইত্যাদি সাইক্লোনকে হেলায় হারিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এই  "গ্ৰ্যান্ডফাদার ট্রি"। কিন্তু সে হার মানলো কিছুদিন আগে "আমফান" নামের যে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় এসেছিল তার কাছে। এই ভয়ঙ্কর সাইক্লোনে  মাটিতে উপড়ে পড়েছে পুরনো অংশের বেশ কিছু গুঁড়ি।

কিন্তু আবারও নিশ্চয়ই মাথা তুলে দাঁড়াবে এই "বৃক্ষ বিস্ময়".. আমাদের বাংলার গর্ব হয়ে আরো শত শত বছর বেঁচে থাক এই বৃক্ষ ঠাকুরদা বা ঠাকুরমা "দ্য গ্ৰেট ব্যানিয়ন"... বোটানিক্সের মহাবট।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...