‘ডাকাডাকি’র যৌথ পরিবার

রাঙ্গাদাদু। ফুলদিদা। নতূন মাসি। ন’পিসি। মণিমামা।
ডাকগুলো আজ অচেনা। অথচ একদিন তিন মহলা বাড়ির কড়ি-বরগা হইহই করত এই সব ডাক আর দরাজ গলার আওয়াজে। সকাল থেকে রাত সদা-সর্বদা জমজমাট।
বৈঠকখানা থেকে হেঁশেল যেখানেই চোখ যায় সেখানেই জলজ্যান্ত সিনেমা। রিল চলছেই...
একান্নবর্তী বাঙালি পরিবার। যৌথ বন্দোবস্ত। এক সঙ্গে থাকা। ‘বাবা’, ‘মা’ বাদ দিয়েও ঘিরে থাকত অজস্র সম্ভাষণ।
অবারিত আবদার। মাসতুতো-পিসতুতো থেকে পাড়াতুতো গ্রাম বা শহরতুতোও- কেউ ‘পর’ নয়।
সে এক কাল ছিল বাঙালির। বাড়ির অন্দরে পা রাখলে বোঝার উপায় থাকত না কে যে ঠিক কার কে হয়।
‘ডাক’ শিখতে শিখতে বছর পাঁচ পার হয়ে যেত বাড়ির বাচ্চার। তবু যেন কোনটা কোন মাসি, কোনটা কোন মামার- গণ্ডগোল আর যায় না।
সবে কথা শিখতে শুরু করা শিশুর মতোই হাল হত সদ্য বিবাহিত জামাইবাবুটির। নতুন বউমাও অস্থির শাশুড়িদের ‘সিরিয়াল-নম্বর’ মনে রাখতে গিয়ে।
অবাধ আবদারের মতঅই চলত অবাধ শাসন। বাবা-মা বাদেও বাড়ি ভর্তি গুরুজন। সবার বড়, বাড়ির ‘বড়’। শাসনের ব্যাটন থাকত তাঁরই হাতে।
স্কুল-কলেজে ভর্তি, পড়াশোনা, বিয়ে থেকে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না, জানলায় হাসা যাবে না- সব বিষয়ে শেষ কথা তিনিই।
এমন সব বাড়ির অন্দরের গড়ন ছাপ ফেলত সত্তর-আশির দশকে বাংলা সিনেমার চিত্রনাট্যেও। ছবির গল্প হত পরিবারকেন্দ্রীক। যৌথ পরিবারের রোজকার খুঁটিনাটি নিয়েই আবর্তিত হত ছবি।
শুধু বাংলা সিনেমাই নয়, সাহিত্যের দিকে চোখ দিলেও ছবিটা একই। সামাজিক গল্প উপন্যাসের বুনিয়াদ পরিবার কেন্দ্রীক।
যৌথ পরিবারের চেনা ‘ডাক’ আবার অনেক সময়ই হয়ে উঠত সার্বজনীন। বাড়ি থেকে পাড়া, পাড়া থেকে আরও দূরবর্তী। একের ডাক অন্যে ডাকলে চটে ওঠা নেই ‘ফর্মালিটি’র হিসেবনিকেশে।
গত কয়েক দশকে আমূল বদলে যাওয়া বাঙালি অন্দরের সঙ্গে এই ছবি আর মেলে না। সময়ের দলিল থেকে গিয়েছে গল্পে, সিনেমায় আর স্মৃতিতে। গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে ওঠার ব্যস্ততায় ছোট হয়েছে পরিবার। ভেঙে গিয়েছে দ্বীপ হয়ে। সময়ের নদীতে ভাসতে ভাসতে ফিকে হয়েছে হাত হয়েছে আলগা। ডাক গিয়েছে হারিয়ে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...