ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতেন জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করবেন। মাত্র ৬ ছ’বছর বয়সেই স্থির করে ফেলেন অন্য কিছু নয়, জীবাশ্মবিদই হবেন তিনি। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হল তিরিশ বছর বয়সে এসে। নিজের স্বপ্নের কাজের জগতে প্রবেশ করলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ধাক্কা খেল স্বপ্ন। এক অন্য পৃথিবীর দরজা খুলে গেল তাঁর চোখে। কিন্তু এই পৃথিবী বড় কঠোর। বড় রূঢ় তার মাটি। তাঁকে কাজের জায়গায় তীব্র লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিন কুরানো পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী। গবেষক। জীবাশ্মবিদ। বর্তমানে আমেরিকার ইওমেইং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। জীবাশ্ম বিজ্ঞানের কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপি প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছেন আজ।
ইলিন এর কথায়, ‘একটা ফ্যাকাল্টি মিটিং চলছে। অনেক কিছু নতুন ভাবনা নিয়ে সেই মিটিং-এ আছি। অনেক কিছু বলার আছে আমার। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার উপস্থিতি নিয়ে আদৌ কেউ কিছু ভাবছে না। আমি যে আছি, আমার যে নিজস্ব ভাবনা চিন্তার জায়গা আহে। বক্তব্য আছে সে তো দুরের কথা, আমার অস্তিত্বটাকেই স্বীকার করছে না কেউ। ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। খানিক পর দেখলাম এক প্রফেসর কাকতালীয় ভাবে আমার ভাবনাটাই সেখানে বলছেন! আর সেটাই সেই আলোচনা সভার সেরা আইডিয়ার সম্মান পেল।’
বিজ্ঞান গবেষণার এই ক্ষেত্রটিতে মহিলাদের উপস্থিতি মাত্র ১৬ শতাংশ। সেই মহিলা বিজ্ঞানীদের মেধা, প্রতিভা, শ্রম, ঘামের মর্যাদা দেওয়া হত না। কাজের জায়গায় লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য এতটাই তীব্র যে মনে হত সমস্ত সম্মান, সুযোগ, আনুকূল্য ‘গোঁফ-দাড়ি’র মধ্যেই।
ইলিন কুরানো বলেন, সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিকতার কাছেই বারবার পিছিয়ে পড়তে হত। সেই হতাশা এমনই যে মাঝেমাঝে মনে হত, নিজের গালে দাড়ি লাগিয়ে কাজের জায়গায় যাই।’
ব্যাক্তিগতভাবে নিজের শিক্ষা, মেধা এবং যোগ্যতার অপমান বলে মনে হয়েছিল। যার উত্তর দেওয়ার মত সপাট জবাব তিনি খুঁজছিলেন। একদিন পেয়েও গেলেন । সঙ্গে পেলেন আরও বেশ কিছু মানুষকে। তাঁরই মতো বঞ্চনা পুড়ছিলেন যাঁরা। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে শুধু মহিলা হওয়ার কারনে প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল।
জন্ম হল দ্য ব্রেডেড লেডি প্রোজেক্টঃ চ্যালেঞ্জিং দ্য ফেসেস অফ সায়েন্স এর। মহিলা চিত্র পরিচালক লেক্সি মার্শ এর পরিচালনায় তৈরি হল তথ্যচিত্র। বিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিতে মহিলা গবেষকরা কীভাবে প্রতিদিন বৈষম্যের শিকার হতে হয়। সায়েন্স ক্লাবের মেম্বারশিপের ক্ষেত্রে ‘গোঁফ দাড়ি’ কীভাবে ‘মেম্বারশিপ কার্ড’ হয়ে উঠতে পারে! এমন অজস্র ঘটনা।
পেশাগত ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতিবাদ হিসেবে পৌরুষের প্রতীক ‘ গোঁফ দাড়ি’ কেই বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের ৪০ জন বিজ্ঞানী। সাদা-কালো তথ্য চিত্রে তাঁরা পর্দায় এসেছেন দাড়ি এবং গোঁফ সমন্বিত হয়েই। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁরা পুরুষ না মহিলা। তবে ছদ্মবেশ বা বেশ বদল নয়। পেশার ক্ষেত্রে দক্ষতা, পারদর্শীতার বদলে যখন তুমি পুরুষ না নারী এই বিভাজনকে বেশি গুরুত্ব তখন সেই ভাবনার শিকড়ে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছেন ইলিন কুরানোর মতো মানুষরা। কর্ম ক্ষেত্রে লিঙ্গবিভাজন বিশ্বব্যাপি সমস্যা।
এই তথ্য চিত্রের জন্য যখন প্রথম কাজ শুরু হয় তখন মাত্র ১০ জন মহিলা জীবাশ্ম বিজ্ঞানীকে পাশে পাওয়া গিয়েছিল। দ্বিতীয়বারের শুটিং-এ ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্ম বিজ্ঞানী সিন্থিয়া লুই যোগ দেন। তাঁর ল্যাবরেটারিতে ৩০ জন গবেষক ছিলেন। তাঁরা সকলেই তথ্যচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
তথ্য চিত্রে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তথ্যচিত্র ছাড়াও ৪০ জন বিজ্ঞানীর আলোকচিত্রের একটি প্রদর্শনীর আয়োজনও করা হয়। Society for Vertebrate Paleontology (SVP) আর Geological Society of America (GSA) তে দেখান হয়।
কিন্তু কিভাবে জুটি বাঁধলেন ইলিন আর লেক্সি?
দুজনেই ভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ। ইলিন বিজ্ঞানের আর লেক্সি কলাবিদ্যার। কিন্তু দীর্ঘ দিনের বন্ধু। কাজের ক্ষেত্র আলাদা হলেও সমস্যাগুলো চেনা। রাগ, কান্না, আবেগগুলোও একই।দুজনেই খুঁজছিলেন প্রতিবাদের ভাষা। লেক্সির ভাষায়, ‘ ইলিন আমার কাছে সুপারহিরো। ওঁর কাজ, ওঁর গবেষণার বিষয় আই জানতাম। ওঁর রক্ত-ঘাম ঝরানো লাঞ্ছনার গল্পগুলোও অজানা ছিল না। ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগেও ইলিন এত কিছু তার কেরিয়ারে করে ফেলেছে যেগুলো আমার ছোট বেলার স্বপ্ন ছিল। ও যেভাবে ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হয়েছে, একটা সময় পর মনে হল আসলে সবটা আমার সঙ্গেই হয়েছে’।
‘অ্যাকাডেমিক ওয়ার্ল্ডে’র কর্মক্ষেত্রে একজন মহিলা জীবাশ্ম গবেষক ১২ ঘন্টা কীভাবে, কতটা কঠিন পরিস্থিতিতে কাটান, কিভাবে প্রতিটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেখুক দুনিয়া। জানুক পৃথিবী। এই ৪০ জন মহিলা বিজ্ঞানীর কাজ জীবনের গল্পের মাধ্যমে তাঁরা এটাই বলতে চেয়েছেন।