আসা যাওয়ার মাঝে বৈশাখী পারাপার। এক বৈতরণী। সংগ্রহে অজস্র সম্মান আর এক আকাশ ভালোবাসা। তিনি চলচ্চিত্রের এক ধ্রুবতারা যাঁর পা সর্বদা ছুঁয়ে থেকেছে বাংলার মাটি। "বেশ জোর গলায় বললাম, “ভরা সংসার ফেলে কোথায় চললে, ফিরে এস, ফিরে এস—।" ডা. বক্সী বললেন, “উনি চলে গেছেন মিসেস রায়, ওঁকে যেতে দিন ।" আমি অবুঝের মতো বললাম, “না না উনি আমার কথা খুব শোনেন, আর দু-একবার ডাকলেই ফিরে আসবেন।"
ফিরে আসেননি তিনি। ফিরে আসার কথাও নয়। কর্মক্লান্ত হৃদয় যে বিশ্রাম নিয়েছিল চিরতরে। তিনি সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্রের আঙিনায় স্বপ্ন চারণ ছিল যাঁর নিজস্বতা। সহধর্মিণী শ্রীমতী বিজয়া রায় ' আমাদের কথা ' বইতেই উল্লেখ করেছিলেন রায় বাবুর সঙ্গে শেষ কথোপকথন। মৃত্যুকে তিনি কখনই বিনা ভূমিকায় চিত্রিত করেননি। প্রায় সব ছবিতেই মৃত্যু অনুষঙ্গ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। পাশাপাশি সেই উপস্থিতি একইসঙ্গে জীবনের কথাও বলে ওঠে।
হ্নদযন্ত্রের বিকল অবস্থা, প্রায় মৃত্যু মুখে, সঙ্গে সব সময় ডাক্তার ও এ্যাম্বুলেনস। তবুও ছেড়ে দেননি চলচ্চিত্রের স্বপ্নময়তা। এভাবেই সিনেমা জগৎ উপহার পেয়েছিল তাঁর অন্তিম স্বর্ণ আখর। ছবির নাম আগন্তুক। সেই মনমোহন মিত্রের কথাতেও মিশেছিল সমাজবাদী শিল্পীর মনন। "STRUGGLE - বাঙালীর অতি প্রিয় শব্দ । আমি অবশ্য এটাকে struggle বলি না - বলি মগজের পুষ্টি , মাংসপেশীর পুষ্টি আর মানুষ চেনার পথে প্রথম পদক্ষেপ ।"
বেঁচে থাকার এই স্ট্রাগল তো তাঁর সহজাত। কলকাতা ট্রিলজির আরতি হোক কিংবা সিদ্ধার্থ, এইভাবেই স্ট্রাগল পেরিয়ে দেখতে চেয়েছিল বিকেলের সূর্যাস্ত। শুধু দেখে যেতে পারলেননা সেলুলোয়েডের রূপকার। বেল ভিউ নার্সিংহোম এর ঘরে এইভাবেই স্ট্রাগল চলছিল বাস্তবের অপুর। বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। সতীর্থ আরেক তারা অনেক আগেই মেঘের ঠিকানার বাসিন্দা। পাশে পেলে হয়ত বলে উঠতেন, ' বাঁচতে চাই। '
স্ত্রীর জবানীতেও সেই একই কথা জানা যায়। অন্ধকার কোমায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিরন্তর বলতেন, " দুইজন শক্ত সমর্থ লোক হলেই বাড়ি ফিরতে পারবো আমি "। কিন্তু ফেরা হয়নি আর! ফিরবেন কীভাবে! তখন যে ইন্দির ঠাকুরণ, দূর্গা, সর্বজয়া ও আরও কত চরিত্ররা তাঁদের প্রাণের ঠাকুরের আশায় প্রহর গুনছেন। ২৩ এপ্রিল। আর দেখে যেতে পারেননি শেষ সূর্যাস্ত। বিকাল পাঁচটা বেজে বাহান্ন মিনিটে বাঙালি হারালো তাঁর আসল মানিক।