কল্লোল কবি জীবনানন্দ
ছেলেবেলায় ভাইকে বলেছিলেন মনপবনের নৌকা বানিয়ে ভেসে বেড়াবেন বাংলার নদী।
ধূসর পাণ্ডুলিপি-র রঙে রাঙানো তাঁর জীবন। রবীন্দ্রনাথ নামের শুক তারা -টি ঘন মেঘে ছেয়ে গেলে বাংলা কাব্যের শুকানো গাঙে যে নতুন জোয়ারের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, তাঁর নাম-
জীবনানন্দ দাশ। বাংলা কবিতার এক রোখা ক্যানভাসের এক ব্যতিক্রমী রঙ।
অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্মানো এক উন্মুক্ত ঘাস। বাংলার রোদ, জল, হাওয়া মেখে বড় হওয়া ঘাস মাটিতে কান পেতে শুনতে পেয়েছিল প্রকৃতির অনুচ্চারিত কথন, বেদন।সেই কবি রূপসী বাংলার পাল ধরা নৌকায় বেয়ে অচেনা রুপকে দেখতে চেয়েছিল প্রেমের বনলতা-কে।
মহাপৃথিবীর বাস্তবে ঝরা পালক এর মত উড়িয়ে দেন প্রান সত্তা।ইনিই জীবনানন্দ।
যাঁর সব পাখি ঘরে ফিরলেও, ফেরেননা তিনি। কচি সবুজ আকশে উঠে স্বপ্ন দেখা কবির জন্ম শহরের কঠিনে। বাংলা কাব্যের উপেক্ষিত, একপেশে ও একলা শব্দগুলো প্রথম মর্যাদা পেয়েছিল কবিকল্পে।
ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী। আর্থিক অনিশ্চয়তায় ঘেরা। একের পর এক চাকরি বদল। লোকের সঙ্গে সহজ না হতে পারা। সর্বোপরি সমালোচকদের আক্রমণে বিধ্বস্ত । ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে কবিতার শব্দরাই ছিল দোসর।
পারিবারিক আবহের সুর পিছনে ফেলে নিজের ছন্দে এনেছিলেন প্রকৃতির না শুনতে পাওয়া সুর। পাখির গান। বাতাসের মূর্ছনা।
রক্তে কবিতা ছিল। সেই জিন এসেছে মা কুসুমকুমারী দেবী-র দৌলতে।মনে পড়ে ছেলেবেলায় আওড়ানো সেই পংক্তি আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে...
ছেলেবেলার পরিবেশও কবির সহায় হয়েছিল। যার পিঠে চেপে তিনি রাস্তা খুঞ্জে পেয়েছিলেন দারুচিনি দ্বীপের।
দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে শিক্ষক ও সাহিত্যপিপাসু মা–বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। ডাকনাম ছিল মিলু। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাবার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনে তাঁর বেড়ে ওঠা।
তাঁর কর্মজীবন বন্ধুর। খরস্রোতা নদীর মতো। কখনও চর জাগে তো কখনও তলিয়ে যায় গভীর অতলে। দীর্ঘ বেকার জীবনে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন ।জীবনের অধিকাংশ সময় গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসায়ের চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক।
রবীন্দ্রনাথের নিবিড় প্রকৃতিচেতনা তাঁর কবিতায় দ্যোতনা হয়ে ধরা দিয়েছে। জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্য জীবনের জটিলতা, স্ত্রী- পুরুষের মনস্তত্ত্ব ও যৌন সম্পর্ক। এসময়ের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তাঁর প্রায় গল্প উপন্যাসেই আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ ঘটেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জীবনান্দের কবিতার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় বাঙালি জনতাকে তার “রূপসী বাংলা” তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে।
জীবনানন্দ ছিলেন আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ “বনলতা সেন” নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫৩ সালে পুরস্কৃত হয়। জীবনানন্দের “শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থটি ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করে।
এক বিকেলে হাঁটতে বেরোলেন। দুই হাতে ভর্তি জিনিস। বিকালের তিলোত্তমায় বিভোর হন কবি। সেই বিকালের আকাশেই মিলিয়ে গেলেন। আর বাড়ি ফেরেননি জীবনানন্দ।
ট্রামে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় রোম্যান্টিকতার।শোনা যায় সেই ট্রাম পরে এক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায়! তার আর কোনও অস্তিত্বই নেই।
সেই ট্রামওয়ে জুড়ে আজ শুধু শুন্যতা। জীবনানন্দ আজও ফিরে ফিরে আসেন, বারে বারে।কবির সঙ্গে পাঠকের লেনদেন চিরন্তন।
শুভ জন্মদিন –
‘’আমি কবি, সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি
ঝরাপালকের ছবি’’।