সময়টা অস্থির। সময়টা বারুদে। তবু সেই অস্থির সময়েই কোথায় না কোথাও বেঁচে থাকে বাস্তবের রূপকথারা। এই রূপকথার প্রধান চরিত্র দুই তরুণ-তরুণী। আর একটা ভাঙ্গাচোরা সাইকেল। তাদের নিয়েই গল্প লিখেছেন সুইডিশ লেখক পার জে এন্ডারসন । ‘দ্য আমেজিং স্টোরি অফ দ্য ম্যান হু সাইকেলড ফ্রম ইন্ডিয়া টু ইউরোপ ফর লাভ’।
পিকে মহানন্দিয়া। উড়িষ্যার নিম্নবর্ণের হিন্দু পরিবার থেকে উঠে আসা একজন শিল্পী। পোট্রেট আঁকতেন। স্কেচ করতেন। এটাই পেশা। তাঁর স্লোগান ছিল ’১০ টাকায় ১০ মিনিটে পোট্রেট।’
১৯৭৫ সাল। ডিসেম্বর মাস। পিকে’র বয়স তখন ২৪। রাজধানী দিল্লির কন্ট প্লেসে ছবি আঁকছিলেন একদিন। শীতের সন্ধে। হালকা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসা আলো। হঠাৎ পাশে থমকে দাঁড়ালেন এক সোনালী চুলের মেয়ে। সুইডেন থেকে ভারতে বেড়াতে আসা সদ্য তরুণী শার্লেট ফন হুয়েদবিন। বছর কুড়ি বয়স। পিকের ১০ মিনিটে পোট্রেট আঁকার দাবী আদৌ সত্যি কিনা সেটা দেখার জন্য সে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার ধারের এই স্ট্রাগলার শিল্পীর পাশে। উদ্দেশ্য অচেনা শিল্পীকে দিয়ে নিজের একটা পোট্রেট আঁকিয়ে যাচাই করে নেওয়া শিল্পীর দাবি আদৌ সত্যি কিনা! এখান থেকেই শুরু তাদের গল্পটা। দুই মেরুর দুই মানুষের এক অসাধারণ ভালবাসার গল্প।
এই সুইডিশ তরুণীর জন্য বাইসাইকেলে ইউরোপ পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতের পিকে। অজানা পথ, অচেনা দেশ পার হয়ে পৌঁছেও গিয়েছিলেন প্রেমিকার বাড়ি। সিনেমায় যেমন হয় ঠিক সেভাবেই। যাওয়ার পথে নানা বিপদ, ঝড়ঝঞ্ঝা। কখনও খাবার জুটেছে কখনও জোটেনি। এমনকি রক্ত পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে খাবার টাকা জোগাড় করতে।
ঠিক এমনই এক জার্নি নিয়ে গল্প লিখেছেন সুইডিশ লেখক। ২০১৩-এ সেটাই বেস্ট সেলার। পিকে আর শার্লেটের গল্প সামনে আসার পর সাড়া পড়ে যায়। পিকের গল্পটা যাকে বলে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। শীতের সন্ধ্যে হঠাৎ ক্যানভাসের সামনে সোনালী চুল সবুজ চোখের এক মেয়ে। দেখেই প্রেমে পড়ে যান। কিছুটা যেন হতবিহ্বল দশা। সেটা এতটাই যে ঠিক যেমন হওয়ার ছিল ঠিক তেমন হয়ে উঠল না। পিকের আঁকা ছবি দেখে এতটুকু খুশি হননি শার্লেট।
তবু পরের দিন আবার এলেন পিকের কাছে শার্লেট। সেদিনও পিকের আঁকায় এমন কিছু উন্নতি দেখতে পাননি। শার্লেট কাছাকাছি এলেই নিজের বুকের ধুকপুকুনিটা বেড়ে যাচ্ছিল তা টের পাচ্ছিল পিকে। আঁকায় যে মন দেবেন তার কোনও উপায়ও ছিল না। হাত কেঁপে যেত, দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়তেন। ভাল আঁকা কী করে হবে?
পিকে বলেন, শার্লেটকে দেখলেই মায়ের ভবিষ্যৎবাণীর কথা মনে পড়ে যেত। পিকে যখন স্কুলে পড়তেন তখন উচ্চবর্ণের ছাত্রদের বৈষম্যের শিকার হতে হত তাঁকে। তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণে। দলিত সম্প্রদায়ের। বারবার অপমানের মুখে পড়তেন। মা’কে জানাতেন স্কুলে লাঞ্ছনার কথা। যখন মন খারাপ হত তাঁর মা বলতেন, “একদিন বহুদূর দেশ থেকে আসা কোনও সোনালী চুলের মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে। বদলে যাবে জীবন।”
পিকের বয়স এখন ৬৪। সুইডেনের স্থায়ী বাসিন্দা। তবু দেশের মাটির কথা মনে পড়ে তাঁর। ৪০ বছর আগে দিল্লি থেকে সুইডনের জার্নি তাঁর কাছে এই সেদিনের ঘটনা। পিকে মহানন্দা তখন দিল্লি কলেজ অব আর্টসের চারুকলার ছাত্র। হার্লেট বলেন, “ চওড়া হাসি আর একমাথা কোঁকড়া চুলের পিকেকে দেখে মনে হয়েছিল ছেলেটা দারুন!”
শার্লেট তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হিপি ট্রেইল’ হয়ে ভারতে এসেছিলেন। আকাশে নয়, সড়ক পথে। সে সময় ইউরোপ থেকে গাড়ি, বাইক কিংবা সাইকেলে অনেকেই ভারতে আসতেন। তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্থান হয়ে এদেশে ঢুকতেন বহু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বিদেশি। শার্লেটও সেভাবেই এসেছিলেন।
শার্লেট দেশে ফিরে যাওয়ার সময় পিকেকে যোগাযোগ রাখতে বলেন। ইউরোপে গিয়ে দেখা করার প্রতিশ্রুতিও পান পিকের তরফে। কিন্তু ইউরোপ যাওয়ার টাকা কোথায় তাঁর? কিভাবে যাবেন?
একবছর পার হয়ে যায়। শার্লেট আর তাঁর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে শুধু চিঠি। কিন্তু চিঠি দিয়ে কী সব আবেগ স্পর্শ করা সম্ভব? একসময় যে কোনও ভাবে ইউরোপ যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। প্লেনে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। যাবতীয় ছবির সম্বল বিক্রি করে ৬০ টাকা দিয়ে একটা পুরনো সাইকেল কিনলেন। ইউরোপ থেকে মোটরসাইকেলে কীভাবে বিদেশীরা ভারতে আসে তা জানার পর ‘হিপি ট্রেইল’ দিয়েই তিনি সুইডেন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পিকে বলেন, আমার মনে হয়েছে, ‘মোটরসাইকেলে যদি ইউরোপ যাওয়া যেতে পারে, তাহলে সাইকেলে কেন নয়?’
১৯৭৭ সাল। শেষ জানুয়ারির এক সকালে বেরিয়ে পড়লেন পিকে। সঙ্গে রং-তুলি আর ৮০ ডলারের মত রেস্ত। অজানা পথে তাঁর সঙ্গী হয়েছিল ক্যানভাস। চলার পথে অনেক জায়গাতেই ছবি এঁকে প্রদর্শনী করেছেন। মানুষ খুশি হয়েছে। অনেকে তাঁর ছবিও কেনে। তাঁর সুইডেন যাওয়ার গল্প শুনতে চেয়েছেন মানুষ। সেই গল্প শুনে কেউ কেউ আবার বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণও জানিয়েছে।
জার্নির কথা বলতে গিয়ে পিকের চোখে অন্যরকম দৃষ্টি। তিনি বলেন, “ সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল কাবুল ঢোকার পর। কিন্তু আফগানিস্থান ভীষণ ব্যতিক্রমী দেশ। শান্ত। সুন্দর। বিপুল এলাকা। জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। স্থানীয় মানুষজন শিল্পপ্রেমী। আফগানিস্তানের মানুষ আমার হিন্দিটা বুঝতে পেরেছিল।”
তবে ভাষা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন তিনি ইরানে প্রবেশ করেন। সেবারও ছবি তাঁকে বাঁচিয়ে দেয়। পিকে মনে করেন, শিল্প আর ভালবাসার কোনও নির্দিষ্ট দেশ হয়না। এ এমন এক ভাষা যা পৃথিবীর যে কোনও দেশের মানুষ চাইলেই বুঝতে পারে। চার মাস পর ১১ হাজার কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে পিকে পৌঁছন গোটেনবার্গে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে বোরাস। সেখানেই তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন শার্লেট।
পিকে ট্রেন থেকে নামতেই দৌড়ে আসেন তিনি। দুজনেই দুজনের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! শুধু মাত্র তাঁর জন্য কেউ এভাবে নিজের দেশ ছেড়ে, এক গোলার্ধ থেকে আর এক গোলার্ধে ছুটে আসতে পারে তা বোধের বাইরে ছিল! শার্লেটকে পিকে বলেন, তাঁর গায়ে সারা রাস্তার ধুলো। বহুদিন স্নান হয়নি। তবু পিকে’কে জড়িয়ে ধরেন তাঁর সোনালী চুলের প্রেমিকা।
সাধারন মানুষের চোখে ‘অস্বাভাবিক’ এই জার্নি শেষ হয় পিকে আর শার্লেট এ শুভ পরিণয় দিয়ে। সুইডেনে নতুন জীবন শুরু করেন তাঁরা। পিকে মহানন্দা এখন সুইডেনের এক স্কুলে চারুকলার শিক্ষক। সুইডেন ও ইউরোপের বহু জায়গায় তাঁর ছবি প্রদর্শনী হয়ে গিয়েছে।
তাঁর স্ত্রী শার্লেট গান শেখান। তাঁদের দুই সন্তানও রয়েছে। পিকের সম্পর্কে শার্লেট বলেন, “সে একজন খুব ভাল বাবা, খুব ভাল স্বামী।” সাংস্কৃতিক ব্যবধান তাদের জীবনে কোনও বড় প্রভাব ফেলেনি। ভিন্ন অবস্থানে থেকে এসেছেন দুজনেই। কিন্তু সেই ভিন্নতাই তাঁদের জীবনকে উৎসবমুখর করে তুলেছে।
ইউরোপিয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে পিকের কোনও ধারনাই ছিল না। কিন্তু শার্লেট প্রতি মুহূর্তে তাঁকে সহায়তা করেছে। সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কারনেই শার্লেটের বাড়ির লোক পিকেকে মানতে রাজি ছিল না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁরা মত বদলান। সুইডেনের মাটিতেই বিয়ে হয় তাঁদের।
পিকে বলেন, ‘যে জীবন আমি পেয়েছি তা আসলে উপহার।’