সে এক দিন ছিল, যখন ঠাকুমা দিদিমাদের কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুম নেমে আসত ছোট্ট ছোট্ট দুচোখের পাতায়। সেই গল্পরা যেন এক আশ্চর্য মায়া-জগত। কখনো দুষ্টু রাক্ষসকে জব্দ করতে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে পাড়ি দেওয়া যেত অলীক এক পৃথিবীতে। আবার কখনো এক মিষ্টি বেড়াল আর দুষ্টু ইঁদুরের ঝগড়ায় দিব্যি মেতে ওঠা যেত।
ছেলেবেলা মানেই স্মৃতির পাহাড়। আর সেই স্মৃতিতে মুক্ত যোগ করে 'গল্প শোনা'।
সাদা চুল, কোঁচকানো চামড়া আর স্নেহভরা চোখ মানেই গল্প-দাদু, গল্প ঠাকুমা অথবা গল্প-দিদা। তাঁদের থেকে গল্প শুনে মনে ঝিলিমিলি লেগে যেতো। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর পিঠে চেপে মুহূর্তের মধ্যে চলে যাওয়া যেত নিজের পছন্দের এক কাল্পনিক, মিছিমিছি পৃথিবীতে।
আচ্ছা, কেমন করে উদ্ভব হলো রূপকথার বা অতিপ্রাকৃত এই সব গল্পের? ঠিক তথাকথিত সাহিত্য বা উপন্যাসের মতো উৎস নয় গল্পের।
সময়টা ১৮৮৩ সাল। এক সাংবাদিক এসেছিলেন কলকাতায়। নাম - লালবিহারী দে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে তাঁর বিশেষ চর্চা ও প্রতিভা ছিল। তাঁর আদি বাসস্থান বর্ধমানের একটি গ্রামে। কলকাতার শহুরে জীবন-যাপনের সঙ্গে অনেকখানি পার্থক্য ছিল বর্ধমানের সেই গ্রাম্য জীবনের। সমাজের শ্রেণী সমস্যা তাঁকে বড় কষ্ট দিত।
লালবিহারী দে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন এক শ্রেণী মুক্ত পৃথিবীর, যেখানে থাকবে না কোন বিভাজন। এই স্বপ্নই জন্ম দিল গল্পের। রূপকথার মত লোক-কথা বা ফোক-টেলস। তাঁর স্বপ্নকে তিনি সাজিয়ে তুললেন বইয়ের পাতায়। প্রথম বই প্রকাশিত হলো 'বাংলার লোক-কথা'। বইটি ইংরেজিতে ছিল। পরে তার অনুবাদ হয়েছিল বাংলায়।
সেই গল্প লোকমুখে পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে। নীতি, আদর্শ, বোধ তৈরিতে বাংলার লোক-কথা ছিল এক আশ্চর্য উপদেশের সম্ভার।
এরপর ছোটদের জন্য গল্প মাখানো পৃথিবী এনে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তাঁর 'টুনটুনি ও বিড়ালের গল্প' শিশুমনকে ভাল রাখার মোক্ষম দাওয়াই।
প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টিকে সুন্দর করে উপস্থাপনা করা আছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচিত ছোটগল্পগুলোতে। বাড়ির লোকেদের কাছে এই সব গল্প শুনতে শুনতে কত ক্ষুদের খাবার হাত থেকে পেট অবধি পৌঁছে গেছে।
ঠাকুরমার ঝুলি। নামটা শুনলেই মনের ভেতরটা ধুকপুক করে ওঠে। রাজকন্যা, রাজপুত্র, দুষ্টু দৈত্য, সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি সে যেন এক আশ্চর্য পৃথিবী। কাল্পনিক। মিছিমিছি। অলীক অথচ কী আপন!
এইসব গল্প পড়ার চেয়ে বোধহয় শুনতে বেশি ভাল লাগত। গল্প শোনার নস্টালজিক গন্ধ ছিল রূপকথার গল্পগুলোতে।
'ঠাকুমার ঝুলি'র রচয়িতা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার শিশুমনকে একেবারে আঠার মত আটকে ফেলেছিলেন ঠাকুরমার ঝুলি বইতে।
এছাড়াও পঞ্চতন্ত্রের গল্প শিশুদের এমনকি বড়দেরও বোধ, চিন্তাভাবনা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
রেজাল্ট, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নামক দৈত্যগুলো এসে কখন যেন এইসব রূপকথার গল্প শোনা বা গল্প পড়ার অভ্যেসে রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। এই সব ঝেড়ে ফেলে শুধু ইচ্ছের সোনারকাটি ছোঁয়ালেই আবার আমরা ফিরে পেতে পারি গল্প শোনার সেই আশ্চর্য জগত।