শান্তিনিকেতন নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে কীভাবে যেন মিশে গিয়েছে। রবি ঠাকুর অধরা থাকলেও তাঁর কিছু কিছু চেতনা নিজের মধ্যে অনুভব করি । সেই টানেই শান্তিনিকেতন যাওয়া। উপরি পাওনা হিসেবে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি হাট। শনিবারের হাট আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। এই হাটে শিল্পীদের বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। ডোকরা শিল্প থেকে শুরু করে বাটিক কি নেই সেখানে। বাটিকের উদ্ভব শান্তিনিকেতনে হলেও ডোকরার ইতিহাস, ঐতিহ্য কিন্তু বেশ প্রাচীন।
ডোকরা হল মোম গলানো ঢালাই পদ্ধতিতে তৈরি একটি শিল্প কর্ম। এই শিল্পের ইতিহাস প্রায় ৪০০০ হাজার বছরের পুরনো। সিন্ধু সভ্যতার শহর মহেঞ্জোদারোতে যে ড্যান্সিং গার্ল বা নৃত্যরত নারী মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল তা ডোকরা শিল্পের নিদর্শন। ভারত ছাড়াও মালয়েশিয়া, প্রাচীন মিশর, আফ্রিকা, চীন, জাপান এবং সুদূর মধ্য আমেরিকাতেও এই শিল্পের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
বহু প্রাচীন এই শিল্পের বিকাশ ভারতে প্রথম ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশের বস্তারের জলাকীর্ণ অঞ্চলে। পরে বিহার, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে বিস্তার পায়। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, লোহাকানি আর বিহারের রাঁচীর লোহারডিতে ডোকরার কাজ দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায়, বর্ধমানের গুসকরায়, মেদিনীপুর ও মালদার গ্রামাঞ্চলে ডোকরা শিল্পের কাজ হয়ে থাকে।
ডোকরা শিল্পীরা ঋতুকেন্দ্রিক যাযাবর । প্রথমদিকে ডোকরা শিল্পীদের স্থায়ী কোন বসবাস ছিল না। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের কারিগর গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে না। আবার আদিবাসী বা হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণ বা উপজাতীয় শ্রেণীভূক্তও নয়। শিকলহীন যাযাবর শিল্পী গোষ্ঠী হল এই ডোকরা শিল্পীরা। বর্তমানে অবশ্য তাঁরা যাযাবর জীবন ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে ডোকরা শিল্পের প্রসার ঘটে আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে। মূলত ঝাড়খন্ড থেকে এই শিল্প পুরুলিয়া হয়ে রাজ্যের পশ্চিমপ্রান্তের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর এই জেলাগুলোতেই সাধারণত ডোকরা শিল্পের প্রাধান্য দেখা যায়।
বাঁকুড়া জেলার বিকনা, খাতডার লক্ষীসাগর, লাদনা, ছাতনা শববেড়িয়া এবং বর্ধমানের গুসকরার দরিয়াপুর ও পুরুলিয়ার নাডিহা ডোকরা শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলি অবস্থিত। বাঁকুড়ার বিকনা ও বর্ধমানের দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পের জগৎ জোড়া প্রসিদ্ধি।
ডোকরা তৈরির পদ্ধতি বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষ। সেই সঙ্গে এর কাজ বেশ সূক্ষ্ম ।প্রথমে পুকুরের লাল বা সাদা মাটি আনা হয় এবং তা দিয়ে মাটির মন্ড তৈরি করা হয়। এরপর সেই মাটি থেকে হাত দিয়ে অবয়ব প্রস্তুত করা হয়। অবয়বটির উপর মোম, তেলের প্রলেপ দেওয়া হয়। একদম শেষে নরম মাটির প্রলেপ লাগানো হয়। একটি ছোট ছিদ্র রাখা হয় যাতে সেখানে দিয়ে গলানো পিতল ঢোকানো যায়।
এরপর সেটিকে পোড়ানো হয়। পোড়ানোর ফলে মোম গলে সেই ছিদ্র দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এবার ওই ছিদ্র দিয়ে গলানো পিতল ঢালা হয় এবং শক্ত হলে মূর্তিটি বা শিল্পকর্মটি বের করে আনা হয়।এরপর শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে সেটিকে উজ্জ্বল করা হয়। মাটি ধূনা, সরিষার তেল, কয়লা এবং মোম নূন্যতম জিনিস দিয়ে তাঁরা এক অসাধারণ শিল্প প্রস্তুত করেন।
ডোকরা দিয়ে সাধারণত সের পাই- এক সের, আধসের,ছটাকী, নূপুর, ঘুঙুর ইত্যাদি তৈরি করা হয়।বর্তমানে হিন্দু দেব-দেবীর ছোট বা বড়ো মূর্তি থেকে গহনার বাক্স প্রায়ই সবকিছুই এখন তৈরি করা হচ্ছে।
এই সময়ে ডোকরা শিল্প এবং শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি মূলত পিতলের দাম বৃদ্ধির ফলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়েছে। আর্থিক অবস্হা খারাপ হওয়ায় অনেক শিল্পী এই শিল্প করতে চাইছেন না। তবে একটা আশার আলো দেখা দিয়েছে। ডোকরা শিল্প প্রসারের জন্য সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি মেলায় ডোকরা শিল্পীরা যাচ্ছেন। এছাড়া ডোকরা শিল্প বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
বর্তমান সময়ে নাগরিক জীবনে ডোকরা শিল্পের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডোকরা দিয়ে ঘর সাজানোর পাশাপাশি ডোকরার তৈরি গহনা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রবীন্দ্রসদন, নন্দন বা বিভিন্ন বুটিকে ডোকরার তৈরি গহনাসহ বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই শিল্পের আরও প্রসার প্রয়োজন। তাহলেই শিল্পীরা এই শিল্পের মাধ্যমে তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবতে পারবেন। তা নাহলে হয়তো এই শিল্প শিল্পীর অভাবে হারিয়ে যাবে।