আরাবল্লীর ঢালে ইতিহাসের শহর উদয়পুর। বিখ্যাত লেক ল্যান্ডস্কেপ আর প্রাসাদের জন্য।
রাজপুত ঐতিহ্যের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা এই শহরে প্রকৃতি আর ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতিও মানুষকে প্রবল ভাবে টানে।
রাজপুত সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ চিত্রকলা। হাজার বছর ধরে যা সমৃদ্ধ হয়েছে। সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভাঙাগড়াও এসেছে। কিন্তু দেশীয় শিল্পরীতির মূল ধরন থেকে সরে যায়নি। রাজস্থানী চিত্রকলায় সর্বাধিক পরিচিত নাম মারু-গুর্জর চিত্রকলা। কিন্তু আরও অনেক শিল্প আড়ালেই চাপা পড়ে থাকে। বেশিরভাগ সমইয়েই হারিয়ে যায়। তেমনই এক শিল্প ‘জল সাঞ্ঝি’।
ক্যানভাসে, কাঠে, কংক্রিটে বা অন্য মাধ্যমে আঁকা ছবি তো দেখাই যায়। কিন্তু জলের ওপর আঁকা ছবি সচরাচর ভাবনাতেই আসে না। কিন্তু উদয়পুরের এক অখ্যাত গলির ভিতর বছরের পর বছর ধরে জলের ওপর ছবি এঁকে চলেছেন এক শিল্পী। পারিবারিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার অন্তরাল সংগ্রাম বললেও যা ভুল হয় না। শিল্পীর নাম রাজেশ বৈষ্ণব।
উদয়পুরের একটি মাত্র পরিবারই সেই শিল্পের ধারক এবং বাহকও বটে।
জলছবি নয়, এ হল জলের ওপর আঁকা ছবি। ৩৫০ বছরের পুরনো এক অত্যাশ্চর্য রেওয়াজ।
কৃষ্ণ রাধার দেখা পেয়েছিলেন জলাশয়ের জলে। জলের প্রতিচ্ছবিতে ফুলের রেখাচিত্র। কৃষ্ণ-রাধার আখ্যান থেকেই জন্ম হয় ‘সাঞ্ঝি’ চিত্ররীতির। চিত্রে মূলত রাধা-কৃষ্ণের রূপ এবং কাহিনী তুলে ধরা হয়।
অমাবস্যার প্রতিপদ তিথি থেকে শুরু। এক পক্ষ কাল ধরে জলের ওপর চিত্র অঙ্কন চলে। বুদ্ধ পূর্ণিমার একদিন আগে সম্পূর্ণ হয়।
উদয়পুরে দেখা মিললেও সাঞ্ঝি শুরু হয়েছিল মথুরা এবং গোকুলে। পুশতি মার্গী মন্দিরে ৫০০ বছর আগে এই শিল্পের সূচনা হয়। সে সময়ে রঙ খুব সহজে মিলত না। তৈরি করতে বা সংগ্রহ করতে যথেষ্ট সময় লাগত। তাই অনেক দিন সময় লাগত ছবি করতে।
পরে রঙের সংকট মিটলেও ‘পক্ষকাল’ প্রথা হয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে বৈষ্ণব পরিবার এই শিল্পের চর্চা শুরু করে। প্রায় ৩০০ বছর ধরে যা চলে আসছে।
কী করে আঁকা হয় জলের ওপর ছবি?
প্রথমেই বিশেষ একধরনের পাত্রে সারা রাত জল ধরে রাখা হয়। জল স্থির হলে কালো রঙ বা কয়লার গুঁড়ো ছড়িয়ে ছবির বেস তৈরি করা হয়। তার ওপর স্টেনসিলের সাহায্যে নানা রকম গুঁড়ো রঙ দিয়ে ফিগার আঁকা হয়। স্টেনসিল সরিয়ে নিলেই জলের মধ্যে রঙিন ছবি ভেসে ওঠে।
শুধু রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিরহ- মাথুরই নয়, কৃষ্ণের বাল্যলীলা, নাগলীলা, কংসলীলার গল্প হয় জলের ছবিতে।
তিন শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন শিল্পী।
অত্যন্ত কঠিন হওয়ার কারণে সাঞ্ঝি শেখার জন্য উৎসাহী শিক্ষার্থী বিশেষ পাওয়া যায় না।। তাই ক্রমেই লুপ্ত হওয়ার পথে এগোচ্ছে। অনেকটা সেই কারণেই এই শিল্পকলা আজও পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে আছে। শিল্পী রাজেশ পাঞ্চালী তাঁর নিজের দুই ছেলেকে সাঞ্ঝি চিত্রকলার পাঠ দিয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা থেকেই গিয়েছে।
‘পিতৃপক্ষ’র সময় ‘জল সাঞ্ঝি’ উৎসব হয় চিত্রকলা প্রদর্শিত হয় সর্ব সাধারণের জন্য। পনেরো দিন ধরে শ্রী কৃষ্ণের লীলারূপ দেখানো জন জল সাঞ্ঝির মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, দেশ- বিদেশ থেকে বহু পর্যটক আসেন জলের ওপর ছবির গল্পকে একবার চাক্ষুস করার জন্য।