আগুন এবং চাকা আবিষ্কার না হলে মানব সভ্যতার বিবর্তন এত দ্রুত হওয়া সম্ভব ছিল না। চাকা আবিষ্কারই কিন্তু অন্য শিল্পের পথকে প্রসারিত করেছিল। চাকা শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটায়নি খাদ্যাভাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনেছিল। পোড়া মাংস, ভাত বা অন্য খাদ্য সামগ্রীর জন্য প্রয়োজন পাত্র। চাকার মাধ্যমেই মাটির পাত্র প্রথম তৈরি করা হয়। তারপর তা পোড়ানো হত। এখান থেকেই জন্ম নিল পোড়ামাটির শিল্প বা টেরাকোটার শিল্পের। পোড়ামাটির শিল্প মানব সভ্যতার জন্মলগ্নের চিহ্ন বয়ে চলেছে।
পোড়ামাটির তৈরি মানুষের ব্যবহারের সকল প্রকার জিনিসই টেরাকোটা পর্যায়ভুক্ত হলেও টেরাকোটা শিল্প বলতে ভাস্কর্যকেই বোঝায়। সুমেরিয় সভ্যতা, ব্যবলনীয় সভ্যতা, মায়া সভ্যতা যে কোনও প্রাচীন সভ্যতায় টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভারতবর্ষের সিন্ধু নদী তীরে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর বা তার আশেপাশে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতায় প্রচুর পরিমাণে টেরাকোটার নানান ধরণের পাত্র, দেবদেবীর মূর্তি, স্বস্তিক চিত্র উদ্ধার হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যেও টেরাকোটা ছিল। পোড়ামাটির শিল্পসামগ্রী দিয়েই প্রাচীন সভ্যতার কাল নির্ণয় করা হয়ে থাকে। টেরাকোটা একটি লাতিন শব্দ। “ টেরা” অর্থ “মাটি’ আর “কোটা” অর্থ “পোড়ানো”। অর্থাৎ “টেরাকোটা” শব্দটির অর্থ হল “পোড়ামাটি”। তাই টেরাকোটা শিল্প বলতে বোঝায় “পোড়ামাটির শিল্পকর্ম”।
এক সময় নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র তৈরির মাধ্যমে যে শিল্প যাত্রা শুরু করেছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে, ক্রম উত্তরণের পথে আজ তা বহুরূপে বিকশিত বিশ্বজয়ী শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। টেরাকোটার শিল্প বৈভবের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে যুগ-যুগান্তের শিল্প-সাধনা তথা শিল্প চেতনার ইতিহাস।
শুধু ভারতবর্ষ নয়, চিন, মিশর, ক্রিট, সাইপ্রাস, সুমেরিয়া-ব্যবিলন, গ্রীস, ইতালি এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই শিল্পের বহুল পরিমাণে প্রচলন ছিল। ভারতের দাক্ষিণাত্যে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক টেরাকোটা মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া তক্ষশীলা, মথুরা, পাটনা, ভিটা, বক্সার প্রভৃতি স্থান থেকেও টেরাকোটার মূর্তি পাওয়া গেছে।
ভারতে স্বর্ণযুগ রূপে চিহ্নিত গুপ্তযুগ থেকেই খুব সম্ভবত গৃহসজ্জার কাজে, সামাজিক উতসবে এবং মন্দিরগাত্রে টেরাকোটা বস্তু বিন্যাসের প্রচলন হয়। খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে আসাম, বাংলা এবং কাশ্মীরে বেশ কিছু টেরাকোটা বস্তুর সন্ধান মেলে। দশম-একাদশ শতকে নির্মিত গ্রামাঞ্চলের লোকশিল্প বিষয়ক এবং মন্দির সজ্জার কাজে ব্যবহৃত বহু সংখ্যক মৃৎফলক বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে পাওয়া যায়।
পাহাড়পুরের মতো লোকশিল্পের ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে আসামে এবং বাংলাদেসের ময়নামতী ও সাভারে। একই সময়ে বিষ্ণপুরের নিকট বহুলাড়া গ্রামে প্রায় ৬৩ ফুট উঁচু ইঁট নির্মিত বিখ্যাত “সিদ্ধেশ্বর শিবমন্দির” গাত্রে টেরাকোটা শিল্প ভাস্কর্যের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। সমসাময়িক কালে প্রতিষ্ঠিত, বাঁকুড়ার বালিয়াড়া গ্রামের জরাজীর্ণ মন্দিরটিও টেরাকোটা শিল্পের বৈভব সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
তুর্কি বিজয়ের পর বাংলায় মন্দির নির্মাণের উৎসাহে ভাটা পড়ে। মুসলিম শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৪০০-১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে মুসলিম স্থাপত্যে টেরাকোটা শিল্পের অভ্যুদয় ঘটে, যার উৎকৃষ্ট নিদর্শন মেলে মালদা জেলার গৌড়, পাণ্ডয়া ও আদিনাতে।
খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকের শেষভাগে শ্রীনিবাস আচার্যের নিকট বীর হামবীরের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পর বিষ্ণুপুর তথা মল্লরাজ্যে কৃষ্ণ-বিষ্ণু উপাসনার যে প্রবল ধর্মীয় বাতাবরণ সৃষ্টি হয়, তারই সার্থক ফসল রূপে মল্লরাজ্যে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে অসংখ্য মন্দির গড়ে ওঠে।
মন্দিরগুলির অধিকাংশই ইঁট দ্বারা নির্মিত এবং বহুলাংশে টেরাকোটা অলঙ্করণ শোভিত। এই সব মন্দির সজ্জায় বিভিন্ন মাপের ছাঁচে গড়া টেরাকোটা টালি ব্যবহৃত হয়েছিল। টালিগুলি পরেস্তারা দ্বারা মন্দির গাত্রে এঁটে দেওয়া হত। প্রধানত মন্দিরের সামনে ব্যাপকভাবে টেরাকোটা অলঙ্করণের সমাবেশ দেখা যায়।
মন্দিরের স্তম্ভগুলি টেরাকোটা ভাস্কর্য সজ্জিত করা হয়। কয়েকটি টালির সংযোগে একটি ধারাবাহিক দৃশ্য রচনার দৃষ্টান্তও অনেক আছে। এই নতুন টেরাকোটা ভাস্কর্যে লোকশিল্পের প্রভাব সুপরিস্ফুট।
টেরাকোটা শিল্পের আর একটি বৈশিষ্ট্য নকশা অলঙ্করণ। টেরাকোটা শিল্পে বিচিত্র ফুল, লতাপাতা, প্রস্ফুটিত পদ্ম বা কোরক ও অন্যান্য নানাবিধ নকসার বিন্যাস খুব সুন্দর।
টেরাকোটার অলঙ্করণ-শোভিত মন্দিরগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরের “শ্যাম রায়”, ‘রাধাবিনোদ”, “ জোড় বাংলা” ও “মদন মোহনের মন্দির”, বাঁশবেড়িয়ার “বাসুদেব মন্দির”, চাকদহের “পালপাড়া মন্দির” এবং বড়নগরের “চার বাংলা মন্দির” উৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এই শিল্পের অবনতি দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই শিল্প প্রায় লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে। তবে বর্তমানে টেরাকোটা শিল্পের চাহিদা বাড়ছে। শহুরে শিক্ষিতদের মধ্যে টেরাকোটা দিয়ে শুধু অন্দর সজ্জাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, গহনার চাহিতাও বাড়ছে।
উৎকৃষ্ট এঁটেল বা ল্যাটেরাইট মাটির সঙ্গে খড়কুটো, তুষ, ভূষি প্রভৃতি মিশিয়ে কাদামাটি প্রস্তুত করা হয়। সেই মাটি থেকে মূর্তি, দৃশ্যাবলী তৈরি করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে টেরাকোটা ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। প্রথমে কাদা দিয়ে কোন অবয়ব তৈরি করে নেওয়া হয় । তারপর রোদে শুকানো হয় এবং পরে তা আগুনে পুড়িয়ে মজবুত করা হয়। এই পদ্ধতিতে মাটির ফলকে শিল্পকর্ম উপস্থাপন করাই হল টেরাকোটা শিল্প।
অন্যান্য লোক শিল্পের মতো টেরাকোটা শিল্পেও সরকারী সাহায্য দরকার। সরকারী অনুদান ছাড়া সভ্যতার আদিলগ্নে জন্মানো এই শিল্প এগিয়ে চলা কষ্টসাধ্য। টেরাকোটার শিল্প সামগ্রী বেশি পরিমাণে তৈরির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার তেমনি দরকার শতাব্দী প্রাচীন টেরাকোটা দ্বারা নির্মিত মন্দিরগুলোর। উপযুক্ত রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে মন্দিরগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে।