বছর চারেক আগে, মানে লকডাউনের কিছু আগে কৃষ্ণনগরে এক বন্ধুর বাড়ি প্রথমবার গিয়েছিলাম। গিয়ে ওদের ছাদে উঠেই আমার চক্ষু একেবারে ছানাবড়া! কেন? বলছি। ওদের বিশাল ছাদ। ছাদ তো না, যেন বিঘৎ এক সবজির বাগান। বেগুন, লঙ্কা, টমেটো, শিম, বরবটি, বিমস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, নানান শাক—কী নেই সেখানে! সব ক’টা গাছই বেশ নধর, পুষ্ট, লকলকে, তরতাজা, সবুজে সবুজ, ফলে ফুলে ভরা; দেখলেই চোখ যেন একেবারে জুড়িয়ে যায়। শরীর চনমনে হয়ে ওঠে। এমন ছাদ ছেড়ে নীচে নামতেই আর ইচ্ছে করে না। আশ্চর্য হওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই যেন শেষ হতে চায় না। আসলে, বেগুন প্রভৃতি আমি অনেককেই ছাদবাগানে বেশ ভালোভাবে চাষ করতে দেখেছি; কিন্তু বাঁধাকপি, ফুলকপি আমার পরিচিতজনের মধ্যে কাউকে এভাবে চাষ করতে দেখিনি।
আমার ধারণা ছিল যে, কপি বোধহয় ক্ষেতের মাটিতেই ভালো হয়। কিন্তু ছাদে যে তাকে এত সুন্দরভাবে চাষ করা যায়, আমার সত্যিই ধারণা ছিল না। বন্ধুকে দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘ভাইরে, করেছিস কী! কীভাবে সম্ভব করলি এটা?’ সে তৃপ্তির হাসি হেসে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘অসম্ভব তো কিছু না। অসম্ভব হলে আমি কী সম্ভব করতে পারতাম? আসলে কী জানিস, গাছ ক্ষেতের মাটি, টবের মাটি, উঠোন বাগান, ছাদের বাগান, ব্যালকনি বাগান, সখের চাষ এসব কিছু বোঝে না; সে শুধু বোঝে পর্যাপ্ত রোদ, উপযুক্ত আধার, প্রয়োজনের খাবার, প্রয়োজনের জল আর উপযুক্ত পরিচর্যা। এগুলো ঠিকমতো দেওয়া গেলে আমাদের আবহাওয়ার উপযোগী যে-কোন ফুল, ফল, শাক, সবজি সব ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে ফলানো যায়।
বন্ধুর কথায় সেদিন বেশ বল পেয়েছিলাম। তারপর লকডাউন হতেই ছাদবাগানে সবজি চাষে যখন মন দিলাম, তখন অন্যান্য সবজির পাশাপাশি শীত আসার মুখে ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ওলকপি চাষ করতেও কিন্তু ভুল করলাম না। বন্ধুর পদ্ধতি ফলো করে বেশ সুন্দর সুন্দর ফুলকপি ফলাতে পারলাম, বেশ আঁটোসাঁটো কেজি-দেড় সাইজের বাঁধাকপি ফলাতে পারলাম, ওলকপি গুলোও বেশ ভালো সাইজের হয়েছিল। কাজেই আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ল, উৎসাহ বৃদ্ধি হল চতুর্গুণ। ফলে, সেই থেকে এখনও পর্যন্ত এ-চাষ প্রতি শীতে আমি সফলতার সঙ্গে করে চলেছি। কপি চাষ কম রোদেও বেশ ভালো করা যায়। আপনাদের ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে যদি শুধু ঘন্টাতিনেক বেশ ভালো রোদ আসে, তাহলে এই তিন ধরণের কপি আপনারাও অনায়াসে চাষ করতে পারেন। বেশি না, প্রথম বছর দশটা দশটা করে চারা এনে বসান; আমি নিশ্চিত রেজাল্ট দেখে পরের বছর আরও বেশি চারা বসাতে উৎসাহিত হবেন।
কপি চাষ হয় বেগুন, লঙ্কার মতোই চারা-রোপণ পদ্ধতিতে। বাজারের গাছবিক্রেতার কাছ থেকে যখন চারা নেবেন, তখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট চারা দেখে নেবেন। সেগুলো যেন লম্বায় পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি সাইজের হয়। তার চেয়ে ছোট চারা একদম নেবেন না। আসলে, কপি চারার বয়স একমাস হলে তবেই তা রোপণ করার নিয়ম। এক মাস বয়সের চারা লম্বায় পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি হয়ে ওঠে। এর থেকে ছোট সাইজের চারা মানে, হয় তার বয়স একমাস হয়নি, নয়তো চারাটি নানান কারণে অপুষ্ট। দুটো কারণই চাষের ক্ষতি করে। তাই, চারা কেনার সময় এটা খেয়াল রাখতে হবে।
গাছ বিক্রেতার কাছ থেকে চারা এনে তা সঙ্গে সঙ্গে রোপণ করতে পারেন, আবার কয়েক ঘন্টা পরেও রোপণ করতে পারেন। কয়েক ঘন্টা পরে রোপণ করতে হলে নর্মাল জল আধ কাপ নিয়ে তাতে চারার কাণ্ড ও শেকড় ডুবিয়ে রাখতে হবে। আর দু’একদিন পরে রোপণ করতে হলে একটা পলিব্যাগে খানিকটা কাদা নিয়ে, তাতে গোছাশুদ্ধু চারাগুলোর শেকড় ও কাণ্ড পুঁতে ছায়ায় রেখে দিতে হবে। একটাও চারা নষ্ট হবে না। তবে চারা সঙ্গে সঙ্গে রোপণ করতে হলে আগে থেকেই মাটি তৈরি করে রাখতে হবে, আধার রেডি করে রাখতে হবে। মুদির দোকানে পাঁচকেজি ওজনের মালমশলা দেবার জন্য যে গোলগলা পলিব্যাগ ব্যবহার করে, তাতে আমি কপিসহ সমস্ত সবজি চাষ করি। আপনি দশ ইঞ্চি মুখওয়ালা এবং এক ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বা কেজি দুয়েক মাটি ধরে এমন পলিব্যাগ কপিচাষের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে দশ ইঞ্চির টবেও চারা বসাতে পারেন।
সবজি চাষের জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি একেবারে আদর্শ। তাই দেড় ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে এক ভাগ বালি এবং দেড় ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট সার বেশ ঝুরঝুরে করে মেশালেই উপযুক্ত মাটি তৈরি হয়ে যাবে। ভার্মি কম্পোস্ট কপি চাষের জন্য আদর্শ সার। গোবরের চেয়ে অনেকগুণ ভালো কাজ দেয় এই চাষে। কপির শেকড় নীচের দিকে এক ফুটের বেশি যায় না। তাই পলিব্যাগে এই মাপে মাটি ভরে তলায় চারপাশে দুটো করে আটটা ফুটো করে দেবেন, এই ফুটো দিয়ে যাতে বাড়তি জল বেরিয়ে যেতে পারে। আর টবে মাটি ভরবেন তলায় উপযুক্ত জলনিকাশি ব্যবস্থা মেন্টেইন করে। যাই হোক, একটি পলিব্যাগ বা টবে একটি করে চারা বসিয়ে জল দিয়ে গাছ স্নান করিয়ে পুরো মাটি ভিজিয়ে দেবেন। তারপর গাছশুদ্ধু টবটি দু’দিন ছায়ায় রাখবেন, পরের তিনদিন সেমিশেডে রাখবেন, তারপর ফুল সানলাইটে দেবেন। যাঁদের এতকিছু করার উপায় নেই, তাঁরা প্রথম থেকেই ফুল সানলাইটে টব রাখবেন। তবে চারা বসাবেন বিকেলে। পরদিন সকালে রোদ ওঠার সময় প্রতিটি চারাকে মোটা কাগজের শঙ্কু আকৃতির টুপি পরিয়ে ঢেকে দেবেন, রোদ পড়লে টুপি খুলে দেবেন। এভাবে দিন চারেক চলার পর আর ঢাকা দিতে হবে না। রোদের সঙ্গে তার লুকোচুরি খেলা শেষ, পূর্ণরোদ সয়ে নেবার পালা শুরু হয়ে যাবে।
কপি চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গোড়ায় একদম আগাছা হতে দেওয়া যাবে না। জলও জমতে দেওয়া যাবে না। মাটি শক্ত হতে দেওয়া যাবে না, নিড়িয়ে খুসিয়ে ঝুরঝুরে রাখতে হবে। বুঝে বুঝে জল দিতে হবে। মাটিতে যেন সব সময়ই রস থাকে। তা যেন কখনই পুরোপুরি শুকিয়ে না-যায়; কেননা, এতে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সতেজ ভাব নষ্ট হয়। আবার জল বেশি দিলেও ফাঙ্গাসের আক্রমণ হয়। তাই বলছি যে, বুঝে জল দেবেন। ফাঙ্গাসের সমস্যা দূরে রাখতে সতর্কতা হিসেবে কুড়ি দিন অন্তর এক লিটার জলে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড গুলে মাটি ও গাছের গোড়ায় স্প্রে করে দেবেন।
কপিচারা রোপণের পর যখন দুটো নতুন পাতা মেলতে দেখবেন, তখন খাবার দেওয়া শুরু করবেন। প্রতি দশদিন অন্তর অলটার করে পনেরোঃপনেরোঃপনেরো ও দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ রাসায়নিক সার দেবেন গাছ প্রতি এক চা-চামচ হিসেবে। রেডিমেড দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ কিনবেন না। ইউরিয়া, পটাশ ও গুঁড়ো সিঙ্গল সুপার ফসফেট আলাদা আলাদা কিনবেন, এবং এগুলো পরিমাণমতো একসঙ্গে মিশিয়ে বাড়িতেই দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ সার তৈরি করে নেবেন। এতে রেডিমেডের চেয়ে কাজ ভালো হয়। কীভাবে মেশাবেন? ধরুন একটা বড় চামচ নিলেন পরিমাণ ঠিক করার জন্য। এতে ১ চামচ ইউরিয়া নেবেন, ২ চামচ পটাশ নেবেন আর ৮ চামচ সিঙ্গেল সুপার ফসফেট নেবেন; তারপর এগুলো একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে আপনার দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ সার। এই দুটো রাসায়নিক দিলে জৈব সার তেমন দেবার প্রয়োজন নেই। শুধু মাটি ঝুরঝুরে রাখার জন্য দিনকুড়ি পর পর দু’মুঠো করে কম্পোস্ট সার প্রতি টবে দিয়ে দেবেন। কম্পোস্ট শুধু পুষ্টি যোগায় না, মাটিতে ভেজা ভেজা ভাব ধরে রাখতেও সাহায্য করে।
যেভাবে বললাম, ওভাবে পরিচর্যা করে গেলে কপি চাষে কোন সমস্যা হবে না। এই চাষে যেটুকু সমস্যা, তা হল, পোকামাকড়ের। তবে ছাদে খুব বেশি পোকার আক্রমণ হয় না। একতলার ছাদে কী হবে জানি না, তবে আমার দোতলার ছাদবাগানে শুধু একটা পোকাই জ্বালায়। সেটা হচ্ছে, কাটুই পোকা। এটা কালচে দাগওয়ালা শুঁয়োপোকার মতো দেখতে। এরা দিনের বেলায় টব বা পলিব্যাগের মাটির নীচে লুকিয়ে থাকে, রাত্রে বেরিয়ে এসে গাছের পাতা খায়, পাতা ফুটো করে, ঝাঁঝরা করে দেয়, ফুলকপির কচি ফুল নষ্ট করে, বাঁধাকপি বাঁধতে শুরু করলে তাকেও এফোঁড় ওফোঁড় করে বারোটা বাজিয়ে দেয়। গাছের পাতার খাঁজে গাছের তলায় এদের গুলি গুলি মল পড়ে থাকতে দেখা যায়। এদের নিকেশ করার দুটো উপায় আছেঃ
এক, দেখতে পেলেই এদের টিপে মেরে ফেলা। রাত্রে এরা বেরোয়, কাজেই রাতে বাগানে হানা দিয়ে গাছের পাতা উল্টেপাল্টে দেখলে সহজেই এদের খুঁজে পাওয়া যায়, তখন মেরে ফেলা যায়। দিনে কাঠি দিয়ে টব বা পলিব্যাগের মাটি নাড়াচাড়া করেও এদের খুঁজে বের করে মারা যায়। আমি হাতে মেরেই এদের নিকেশ করি। লেখার সঙ্গের ছবিতে যে গাছগুলো দেখছেন, সেগুলো আমার বাগানের; তাদের এভাবেই ভালো রেখেছি। আপনার ছাদবাগানে পোকাখেকো পাখি এলে তাদের তাড়াবেন না, তারা এই পোকা খেয়ে আপনাকে সাহায্য করবে।
দুই, প্রথম পদ্ধতির হ্যাপা বা ঝক্কি যারা নিতে চান না, তাদের কাছে একমাত্র উপায় কারটাপ গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে। কীটনাশক স্প্রে করলে সমস্ত সতর্কতাবিধি মেনে চলবেন।
তবে আপনার ছাদ বা ব্যালকনি বাগান যদি তিন থেকে চারতলায় হয়; তাহলে হয়তো এ পোকার আক্রমণ না-ও হতে পারে। আমি এই যে তিন-চার বছর কপি চাষ করছি, তাতে এই কাটুই পোকা ছাড়া অন্য কোন রোগবালাইয়ের সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি; আশা করি মাটি ঠিক থাকলে আপনাদেরও বাড়তি কোন ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হবে না। তাই এবার নিশ্চিন্তে কপি চাষ করুন, নতুন একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজের ছাদ ও ব্যালকনি বাগান ভরিয়ে তুলুন।।...