শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পটা মনে আছে? রাস্তার একটা পাথর খন্ড মানুষের ভক্তি আর বিশ্বাসের জোরে দেবতা হয়ে ওঠে। কথায় আছে সাহিত্য আসলে সমাজের দর্পণ। সমাজে কিছু বিষয় ঘটে বলেই এটা সাহিত্যে উঠে আসে। একটি পাথর খন্ডের দেবতার রূপে রূপায়িত হওয়ার গল্প শুধু সাহিত্যের পাতায় নয় বাস্তবেও রয়েছে। কোথায়? উত্তরবঙ্গের মেখলীগঞ্জে। উত্তরবঙ্গের মেখলীগঞ্জ ব্লকের নিজতরফ গ্রাম পঞ্চায়েতের নালার পার এলাকায় বেশ কয়েক বছর ধরে পুজো করা হচ্ছে টেনশন ঠাকুরের।
বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। বেকারত্ব, চাকরির অভাব, এসব নিত্য সমস্যা। বয়স বেড়ে যাচ্ছে অথচ কোন চাকরির খবর নেই, এমনকি কোন সুরাহা হওয়ারও উপায় দেখা যাচ্ছে না, কোচবিহারের মেখলীগঞ্জে এই সমস্যা সকলের পরিচিত। মোটামুটি সকলেই শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী, অথচ চাকরি পাচ্ছেন না কেউ। ছেলে-মেয়েদের মনে টেনশন, ডিপ্রেশনের বাড়-বাড়ন্ত। এমন মানসিক অস্থিরতার ভাবনা থেকে মেখলিগঞ্জের ছেলেমেয়েরা ওই অঞ্চলের বিশেষ পুরোহিত গনেশ অধিকারীর কাছে যায়। পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকা গণেশ অধিকারী তখন তাদের টেনশন ঠাকুর নামের দেবতার পূজা করতে বলেন। মূলত স্কুলের পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লে যে ঠাকুরের কাছে সহজে মাথা নুইয়ে এ কথা বলা যাবে এবং ফল পাওয়ার আশাও করা যাবে তার উদ্দেশেই টেনশন ঠাকুরের পুজো শুরু হয়। গণেশ অধিকারী টেনশন ঠাকুরের পুজো তো করতে বলে দিলেন কিন্তু ঠাকুরের মূর্তি কই? অবয়ব কি হবে? গণেশ অধিকারী তখন উপায় বাতলে দেন। ওই অঞ্চলে সেই সময় রাস্তার কাজ চলছিল। একটি মানুষের মুখের আদলে বড় বোল্ডার পাথর তুলে মালী ঠাকুরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় । সেই মূর্তিকে ভালো করে ছেনে তার ওপর আঁকিবুকি কেটে একটি মুখাবয়ব তৈরি করে দেন মালী ঠাকুর। মাথায় বাটিছাঁট, চুল বড়, সুস্পষ্ট জুলফি, জাদরেল গোঁফওলা এই ঠাকুরের নাম টেনশন ঠাকুর। বড় বড় মায়া-ভরা দুই চোখে টেনশন ঠাকুর নাকি স্কুল বা চাকরির পরীক্ষার সমস্ত টেনশন নিজের কাঁধে তুলে নেন।
কথিত আছে এই পুজো শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই নাকি বেশ কিছু ছেলে মেয়ের চাকরি হয়েছিল। একেবারে সাধারণ উপাচারে পূজা করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে এই পুজো হয়। আলাদা করে কোন মন্ত্র নেই। সাধারণ ফল-মূল, ধূপ ধুনো, নৈবেদ্য রাখা হয় ঠাকুরের সামনে। এছাড়া পুজোর প্রসাদ বলতে সকলকে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়।
আজও পরীক্ষার সময়টাতে কাতারে কাতারে মানুষ টেনশন ঠাকুরের পুজো দিতে মেখলিগঞ্জে পৌঁছে যান। একেবারে নিজের পরিবারের মানুষের মতো করে টেনশন ঠাকুরের পুজো দেওয়া হয় উত্তরবঙ্গে।