'ব্যাড বয়'দের মন্দির

আমাদের তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতা, তাই ভগবান আর ভগবানের মন্দির কোনটারই অভাব নেই এই দেশে। মন্দির মানে উপাসনার স্থান, আমরা ভগবানকে পুজো করি সেখানে। কিন্তু এই দেশেই এমন অনেক মন্দির আছে, যেখানে ভগবানের আরাধনা হয় না। সেই সব মন্দিরে 'ব্যাড বয়'রা পূজিত হন। হ্যাঁ, নায়কের সঙ্গে সঙ্গে খলনায়কদেরও মন্দির রয়েছে এদেশে।
সে সব মন্দির খুঁজতে আমাদের চলে যেতে হয় দক্ষিণ ভারতে।

 

তবে তারও আগে টাইম মেশিন চেপে দৌড় দিতে হয় মহাভারতে। মহাভারত যেমন কৃষ্ণ, অর্জুনের কথা বলে, তেমনই মহাভারত শকুনি দুর্যোধনের কথাও বলে। শকুনি মহাভারতের এমন এক চরিত্র যাকে ছাড়া হয়ত মহাভারতই হত না। শকুনির ক্রোধ থেকেই মহাভারতের জন্ম, কুরুক্ষেত্রের জন্ম। নিজের বোনের স্বামী হিসেবে একজন অন্ধকে কোনদিনও মানতে পারেননি শকুনি। বিবাহবাসর থেকে গান্ধারীকে তুলে নিয়ে যান ভীষ্ম, তাই ভীষ্মের উপর শকুনির বরাবরের রাগ।

 

শকুনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি কৌরবদের ধ্বংস করবেন। তিনি নিজের প্রতিজ্ঞা রেখেওছিলেন। শকুনি ছিলেন শিবের উপাসক। মহাভারতের একটি খল ও মন্দ চরিত্রের শঠ মানুষ হলেন শকুনি। কিন্তু তিনি নিজের প্রতিজ্ঞার প্রতি সৎ ছিলেন। প্রতিজ্ঞার প্রতি তিনি এতটাই দায়বদ্ধ ছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞায় অবিচল ছিলেন।

 

Badboys1

 

তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, প্রতিশোধ নেওয়া। তাই রাজসুখ তিনি হেলায় ত্যাগ করেছেন, তাঁর এই ত্যাগের কথাই স্মরণ করে তৈরি হয়েছে এই মন্দির। শকুনির মন্দির। দক্ষিণ ভারতের কেরালার কোল্লাম জেলায়, পবিত্রেশ্বরমে রয়েছে এই মন্দির। এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন স্থানীয় কুরুবা সম্প্রদায়ের মানুষজন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই কুরুবার সম্প্রদায় হল কৌরবদের বংশধর। প্রচলিত ইতিহাস মতে, শকুনি কৌরব ভাইদের নিয়ে ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, তখন এই পবিত্রেশ্বরমে এসেই শকুনি শিবের উপাসনা করেন।

 

এখানেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে কৌরবদের মধ্যে অস্ত্র ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। তাই এখানেই শকুনির মন্দির গড়ে ওঠে। যার নাম 'মায়ামকট্টু মালঞ্চরুভু মালনাদ'। ভক্তরা এখানে নারকেল, রেশমের কাপড় এবং তাড়ি অর্থাৎ স্থানীয় মদ দিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করেন। এই মন্দিরে কোনও মূর্তির পুজো হয় না। এখানে একটি মুকুটের পুজো হয়। লোককথা অনুযায়ী, এই মুকুটটির মালিক ছিলেন গান্ধাররাজ শকুনি। মন্দিরের মধ্যে রাখা রয়েছে একটি সিংহাসন, মনে করা হয় এই সিংহাসনটিও ছিল শকুনির।
শকুনির মন্দিরের কাছেই রয়েছে, শকুনির প্ৰিয় ভাগ্নে, মহাভারতের আরেক ভিলেন দুর্যোধনের মন্দির

 

কেরালার কোল্লাম জেলার এই মন্দিরটির নাম, 'পেলুভিরথি মালানাদা'। এখানেই পূজিত হন দুর্যোধন। এই মন্দির গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে মহাভারতের এক কাহিনী। পাণ্ডবরা তখন অজ্ঞাতবাসে। পান্ডবদের খুঁজতে খুঁজতে দুর্যোধন এসে পৌঁছলেন এই গ্রামে। গ্রীষ্মের মধ্যে পরিশ্রম আর ক্লান্তিতে তৃষ্ণার্ত দুর্যোধন কাডুথাসেরি সম্প্রদায়ের এক বৃদ্ধের কাছে জল চাইলেন। ঐ বৃদ্ধ তাঁকে জল দিলেন, খাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। কৃতজ্ঞচিত্তে দুর্যোধন তাকে আলিঙ্গন করতে চাইলেন। কিন্তু সেই বৃদ্ধ মানুষটি পিছিয়ে গিয়ে জানালেন, তারা নিচু জাতের মানুষ, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে তাদের আলিঙ্গন করা শোভা পায় না। ঐ বৃদ্ধ মানুষকে জড়িয়ে ধরে দুর্যোধন বললেন, যে প্রয়োজনের সময় জল দান করে তাঁর স্থান সবার ওপরে।

 

Badboys2

 

ফিরে যাওয়ার সময় দুর্যোধন কথা দিয়েছিলেন, সফল হলে তিনি দেখা করে যাবেন। দুর্যোধন পাণ্ডবদের খুঁজে পাননি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজিত হন, তাই আর দেখা করতে আসা হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর পরে দুর্যোধনের আত্মা কথা রাখতে চলে আসে সেই গ্রামে। একদিন রাতে ঐ বৃদ্ধ স্বপ্নে দেখেন দুর্যোধনকে, তারপরের দিনই তার বাড়ির সামনে দেখলেন একটি বটের চারা। সেখানেই বেদি তৈরি করে দুর্যোধনের পুজোর সূচনা করলেন।

 

এই মন্দির আজও রয়েছে, এবং এই মন্দির তথাকথিত বর্ণপ্রথা, জাতপাতের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আজও এই মন্দিরে অব্রাহ্মণ পৌরহিত্য করেন। ওই শুদ্র বৃদ্ধের পরিবার থেকেই আজও বংশপরম্পরায় নির্বাচিত হয় মন্দিরের পূজারী। কেরালার ওই গ্রাম আজও মাতৃতান্ত্রিক, তাই প্রধান পুরোহিতের মৃত্যুর পরে, তাঁর ভাগ্নে পরবর্তী পুরোহিত রূপে নিযুক্ত হন। একে মলনদ মন্দিরও বলা হয়। মন্দিরের মধ্যে কোনও মূর্তি নেই।

 

একটি উঁচু মঞ্চ আছে কেবল, ভক্তরা এখানে এসে এক বিশেষ রকমের ধ্যান করেন, যার নাম সংকল্প। দুর্যোধনের এই মন্দিরটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। ভক্তেরা সুপারি, তাড়ি, দেশি মোরগ, লাল কাপড় ইত্যাদি দিয়ে পুজো দিতে আসেন এই মন্দিরে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এখানে 'মালাক্কুরা' নামে একটি বার্ষিক উৎসব পালিত হয়। এই জমি এবং মন্দিরের জন্যে আজও যে কর দিতে হয় তার রসিদ দুর্যোধনের নামেই কাটা হয়।

 

আবার হিমালয়ের কোলে তমসা নদী, এই নদীর তীরে অবস্থিত মোরি গ্রাম। সেখানেও রয়েছে দুর্যোধনের আরেকটি মন্দির। ইতিহাস অনুয়ায়ী, মোরি গ্রামের মানুষ পাণ্ডবদের বংশধর। তবুও যেদিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয় হল, ভীমের হাতে নিহত হলেন দুর্যোধন, সেদিন চোখের জল ফেলেছিল এই গ্রাম। মনে করা হয়, সেই চোখের জলেই নাকি তমসা নদীর সৃষ্টি। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, আজও নাকি সেই কান্নার জল বয়ে চলে এই নদীতে। সেই কারণে এই নদীর জল কেউ পান করে না। যেকোন বিপদে গ্রামের লোক চলে যান এই মন্দিরে, তারা বিশ্বাস করে দুর্যোধনের কৃপায় সব সঙ্কট কেটে যাবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...