মন্দিরের দেশ তেলকুপি

ভারত ঈশ্বরভক্তদের দেশ। সারা দেশ জুড়েই প্রতিটি স্থানে, পথে প্রান্তরে অলিতে গলিতে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মন্দির। আর এই সব মন্দিরগুলোকে ঘিরে রয়েছে নানান রকম বিচিত্র কাহিনী। জনশ্রুতি মিথ মহাত্ম্য এদের অনন্য করে
তুলেছে। কিন্তু আজও এমন অনেক মন্দির রয়ে গিয়েছে, যাদের সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। যা এখনও মাটির স্তুপ থেকে বের হয়নি। শুধু মাটি নয়, আজও জলের তলায় রয়ে গিয়েছে কিছু নিদর্শন। এই বঙ্গেই রয়েছে এমন একটি জায়গা।
পুরুলিয়ার তেলাকুপি সেইরকমই একটি মন্দির এলাকা। দামোদরের বাঁধ যাকে জলের তলায় তলিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
দামোদর এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ এই মন্দিরকে গ্রাস করে নিলেও, একেবারে গিলে ফেলতে পারেনি। মাঝে মধ্যে যখন জলস্তর নামে, তখন মাথা তোলে মন্দিরগুলো। সবগুলো মন্দির হয়ত এখন অক্ষত নেই। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও শ্বাস নিচ্ছে জলের তলায়। হয়ত এভাবেই দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে অতীতের সমৃদ্ধশালী তেলাকুপি।
দামোদরের অথৈই জল। পাশে দু'টি জীর্ণ দেউল। কিছু দূরে মন্দিরের পাশে অযত্নে পড়ে রয়েছে দেউলের মূর্তি। এটাই বর্তমানের তেলকুপি। অযত্নে সময়ের গ্রাসে নষ্ট হতে বসেছে অতীতের এই বন্দর নগর তৈলকম্প।

গবেষকদের মতে, তেলকুপির প্রাচীন নাম ছিল তৈলকম্প বা তৈলকুম্পী। সাধারণভাবে আমরা বুঝি, 'তৈল' মানে 'তেল'। তবে এই শব্দটির আরেকটি অর্থও রয়েছে। চাণক্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী 'তৈল' ছিল এক ধরনের কর। আর 'কম্প' মানে 'কম্পন' অর্থাৎ পরগনার মতো ছোটো প্রশাসনিক অঞ্চল। তৈলকম্পী ছিল কর প্রদানকারী অর্থাৎ করদরাজ্য বা উপনিবেশ। প্রাচীন যুগে শিখর বংশীয় রাজাদের অন্যতম রাজধানী ছিল এটি, রাজা রুদ্রশিখর পাল আমলে রাজত্ব করতেন। সন্ধ্যাকর নন্দী 'রামচরিত'-এ লিখেছেন, রুদ্রশিখর অন্যান্য সামন্তরাজাদের সঙ্গে জোট বেঁধে পাল সম্রাট রামপালকে বরেন্দ্রভূমি দখল করতে সাহায্য করেছিলেন। বোড়ামের এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, রুদ্রশিখর ছিলেন তৈলকম্পীর শাসক। কংসাবতী নদীর উত্তর থেকে দামোদর নদীর দক্ষিণ পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজ্যের সীমানা। তবে, বেশ কিছু জৈন দেবমূর্তিকে পরবর্তীকালে হিন্দুরা নিজেদের মতো করে পুজো করতে থাকেন।

পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থানার অন্তর্গত এই তেলাকুপি অঞ্চল। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের সদর চেলিয়ামা থেকে কমবেশি সাত-আট কিলোমিটার দূরের এই তেলকূপি এখন লোক গবেষকদের গবেষণার বিষয়। গবেষকদের মতে, তৈলকম্প লোকমূখে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে তেলকুপি হয়েছে। দামোদরের দক্ষিণ পাড় একদা সমৃদ্ধশালী এলাকা ছিল। এই বন্দর থেকে তাম্রলিপ্ত অর্থাৎ অধুনা তমলুকের সঙ্গে জলপথে চলত বাণিজ্য।এই বন্দরেই জৈন ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছিলেন মন্দির নগরী। লালপুর, গুরুন, তারাপুর, ঘরবিড়া ইত্যাদি গ্রামগুলি নিয়ে তৈরি এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিক দিক থেকেও বেশ প্রাচীন। একসময় প্রাচীন শিখরবংশের রাজধানী ছিল এই তেলকুপি। তখন যার নাম ছিল 'তৈলকম্পী'। শিখরবংশের রাজাদেরই পাঞ্চেতের প্রকৃত রাজবংশ বলে ধরা হয়। রামচরিত থেকে এই শিখরদের রাজাদের সম্পর্কে জানা যায়। এদের অন্যতম বিখ্যাত রাজা রুদ্রশিখরের উল্লেখও পাওয়া যায়। এই তেলকুপি অঞ্চলেই একসময় তৈরি করা হয় অনেকগুলি মন্দির। সংখ্যায় এবং কারুকার্যে কারোর থেকে কম ছিল না এই মন্দির। মনে করা হয় এখানকার তৎকালীন রাজবংশ এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা তৈরি করেছিলেন এই মন্দির। ফলে, অনুমান করাই যায়এখনকার জলে নিমজ্জিত অঞ্চলটি একটা সময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।

Tel-Kupir-Madir-01

তেলাকুপির মন্দিরগুলির কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ইন্দো-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রত্নতাত্ত্বিক জে.ডি.বেগলার। ছবিও দেন তিনি। তাঁর মতে, এত কম এলাকায় একসঙ্গে এত সুন্দর এবং উৎকৃষ্ট মন্দির আগে দেখা যায়নি। ১৮৭৮ সালে জিডি বেগলারের 'রিপোর্ট অফ আ ট্যুর থ্রু বেঙ্গল প্রভিন্সেস' রচনাতে এই তেলকুপির মন্দির সম্পর্কে কিছু তথ্য মেলে। যেখানে বেগলার তেলকুপিতে মোট ২২টি মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। দেবলা মিত্রের 'তেলকুপি- আ সাবমার্জড টেম্পল সাইট ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল' বইয়েতে তেলকুপির মন্দির নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে। তা থেকে জানা যায়, একদা তেলকুপিতে ২৫-২৬টি মন্দির বা দেউল ছিল। ফলে তেলকুপির অতীতের স্বণর্র্যুগ নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তাহলে এখন কী হল এই মন্দিরগুলির? এখনও কী আছে মন্দিরগুলো? আপাতত এর উত্তর রয়েছে জলের তলায়। ১৯৫৭ সালে পাঞ্চেতের কাছে দামোদর নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পুরো ব্যাপারটার তদারকিতে ছিল দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। আর সেই বাঁধ নির্মাণের দরুণ, দামোদর উপচে পড়ে। ১৯৫৯ সালের মধ্যে তেলাকুপির অধিকাংশই সেই জলের তলায় চলে যায়। যার মধ্যে থেকে গেছে সেই সমস্ত মন্দির।

Tel-Kupir-Madir-02

মন্দিরের বর্তমান অবস্থা যন্ত্রণার কারণ। কারণ দামোদরের উপরে পাঞ্চেত জলাধার তৈরির পরে এই মন্দিরগুলির বেশিরভাগই চলে যায় নদের গর্ভে। কোনও ভাবে মাথা উঁচিয়ে রয়ে গিয়েছে তিনটি দেউল। তার মধ্যে দু'টিকে বছরের প্রায় সব সময়েই দেখা গেলেও একটি শুধুমাত্র গরমকালে দামোদরের জল কমলে দেখা যায়। বাসিন্দাদের আক্ষেপ, মন্দিরগুলিকে বাঁচিয়ে জলাধার তৈরি হলে হয়ত তেলকুপির ঐতিহ্য হারিয়ে যেত না। আক্ষেপ আরও রয়েছে, টিকে যাওয়া ওই তিনটি মন্দির ও মূর্তিগুলিরও রক্ষণাবেক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেই। একটা স্বর্ণময় অধ্যায় দামোদরের তলায় চলে গেল! দেউলগুলিকে রক্ষা করার কোনও উদ্যোগই কেউ নিলেন না! যেগুলি রয়েছে, তারও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই।

লোকগবেষকদের একাংশের মতে, তেলকুপি নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় তৈলকম্প থেকেই তেলকুপি নামটি এসেছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, সংস্কৃতে তৈল মানে তেল। আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তৈল মানে এক ধরনের কর এবং কম্প কথাটি এসেছে মূলত কম্পন অর্থাৎ পরগনা। এ থেকে তাঁদের অনুমান, তৈলকম্প বা অধুনা তেলকুপি ছিল কর প্রদানকারী বা করদ রাজ্য। তেলকুপি নিয়ে প্রাচীন ইতিহাসে কিছু উল্লেখ না থাকলেও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম কাব্যে তৈলকম্পের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে কবি লিখেছেন যুদ্ধে যার প্রভাব নদী,
পর্বত ও উপান্তভূমি জুড়ে, বিস্তীর্ণ পর্বত কন্দরের রাজবর্গের যিনি দর্প দহনকারী, দাবানলের মতো সেই তৈলকম্পের কল্পতরু রুদ্রশিখর। রামচরিত কাব্যর উল্লেখিত রুদ্রশিখর যে তৈলকম্পের রাজা ছিলেন, জয়পুরের দেওলঘাটার বোড়ামে
একটি শিলালিপি থেকে তা জানা যায়।

তৈলকম্প রাজ্য দামোদরের দক্ষিণ তীর থেকে কংসাবতীর উত্তর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আবার পশ্চিমে ঝালদা থেকে বুধপুর পর্যন্ত ছিল রাজ্যের সীমানা। তৎকালীন পাল সম্রাট রাম পালের সাথে রুদ্রশিখরের বন্ধুত্ব ছিল। ফলে একথা
বলাই যায় সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যে উল্লেখিত রুদ্রশিখর এই তৈলকম্পের রাজা ছিলেন।

তবে ঠিক কোন সময়ে তৈলকম্প বা তেলকুপিতে মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছিল, কারাই বা মন্দিরগুলি তৈরি করেছিলেন সেই বিষয়ে প্রামান্য নথি পাওয়া যায়নি। কিন্তু জেলার লোকগবেষকদের একাংশের মতে, মন্দিরগুলির নির্মাণ মোটামুটি দশম-একাদশ শতাব্দীতে। এবং তা মূলত গড়ে ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা। তৎকালীন সময়ে বাংলায় পালযুগে জৈন ধর্ম প্রসার ঘটেছিল এবং ধর্মের প্রসারে ভূমিকা নিয়েছিল জৈন ব্যবসায়ীরাই। যাঁরা এই অঞ্চলের দু'টি তামার খনি তামাজুড়ি ও তামাখুন। সেখান থেকেই প্রাচীনকালে ব্যবসায়ীরা তামা উত্তোলন করে তাম্রলিপ্ত
নিয়ে যেতেন। তৈলকম্পী ছিল এক বন্দর শহর। এখানকার মন্দিরগুলি খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। ওই সময়ে পুরুলিয়াতে জৈন ধর্মের বেশ কয়েকটি কেন্দ্র বিকশিত হয়েছিল। তেলকুপির মন্দিরগুলিতে জৈন প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। গবেষকরা মনে করেন, এই শহরে
ব্যবসা করতে আসতেন মূলত জৈন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দিরগুলি বানানো হয়েছিল। আশেপাশে বেশ কিছু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। তাই,এখানে হিন্দুদেরও বসবাস ছিল বলে ধরা হয়।

তবে তেলকুপির সমস্ত মন্দির জৈন ব্যবসায়ীরা তৈরি করেছিল কি না তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ তেলকুপি থেকে পাওয়া মূর্তিগুলির মধ্যে অনেকগুলিই হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। অনেকে তাই মনে করেন, জৈন ও হিন্দু
ধর্মের মিশ্র সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছিল তেলকুপি। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন, তেলকুপির মন্দিরে লিপিস্বাক্ষ্য নেই। তাই সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু স্থাপত্যরীতি থেকে মনে হয় এই অঞ্চলে এই রেখবর্গীয় মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছিল নবম-দশম শতকে। চলেছিল অন্তত ত্রয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত।

শুধু মন্দিরই নয়, স্থানীয় লালপুর, গুরুডি, পাথরবাড়িতে এখনও সাত-আটটি মূর্তিও দর্শনীয়। কিন্তু শিল্পকীর্তিতে ভরা ওই মূর্তিগুলিও আজ ভগ্নদশাপ্রাপ্ত। চেলিয়ামারও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। পুরুলিয়া জেলায় রঘুনাথপুরের কাছে দামোদর নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ছিল বিহারের মানভূম জেলায়। এখন রঘুনাথপুর থানার বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেই অবস্থান করছে তেলকুপি।

স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দামোদরের ওপর পাঞ্চেত জলাধার তৈরি হওয়ার পর এখানকার বেশিরভাগ স্থাপত্য নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। আপাতত ভাঙাচোরা অবস্থা টিকে আছে মাত্র তিনটে মন্দির। তার মধ্যে দু'টিকে যেকোন
সময়ে দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে নদীর জল কমে গেলে তবেই আরেকটি মাথা তোলে। মন্দিরগুলির কাঠামো দেউল আকৃতির। জিডি বেগলার, দেবলা মিত্র প্রমুখের লেখা থেকেই জানা গিয়েছে, এখানে ছিল আরও বেশ অনেকগুলি দেউল।

চারপাশের বিভিন্ন গ্রামে আজও লোক মুখে শোনা যায়, "তেলকুপি ভৈরবনাথ হে, অড়ানার বাণেশ্বর হে"। এই ভৈরবনাথ হলেন জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভদেব। তাঁর চিহ্ন ছিল ষাঁড়। ঋষভদেবের বেশ কয়েকটি প্রাচীন মূর্তিকে স্থানীয় মানুষ এখন গ্রামে গ্রামে মহাদেব রূপে পুজো করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...