১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাস। চেন্নাইয়ের একটি বিশেষ প্রদর্শনীসভায় নির্দিষ্ট আকৃতির, বাক্সের মতো একটা জিনিস রাখা হয়েছে। বি শিবকুমার, একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ওই প্রদর্শনীসভায় যন্ত্রটির বিষয়ে বলবেন। কিন্তু কিছু বলার আগে বি শিবকুমার যন্ত্রটির মাধ্যমে একটা অদ্ভুত বিষয় সভায় উপস্থিত সকলকে দেখালেন। একটা পুরনো চিঠি একটি স্ক্যানারের মাধ্যমে স্ক্যান করে তার ছবি ক্যাথোড রে টিউবের সহযোগিতায় ঐ বাক্স-আকৃতি যন্ত্রটির মাধ্যমে সকলকে দেখালেন। ওই চিঠির স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ওই বাক্সের মধ্যে দেখা গেল। সকলেই ধীরে ধীরে দেখলেন শুধু চিঠি নয়, ক্যাথোড রে টিউবের সাহায্যে এরকম অনেক ছবি যন্ত্রটিতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সেদিন সভায় অনেক বৈজ্ঞানিক এবং বিশেষজ্ঞ মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন। এই বাক্স-আকৃতি যন্ত্রটির কথা তাঁদের মধ্যে অনেকেই জানতেন। শুধু স্বচক্ষে দেখা তখনো পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। বি শিবকুমারের প্রদর্শনীটির মাধ্যমে অদ্ভুত যন্ত্রটিকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন সভায় উপস্থিত সকলে। তারপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির হাত ধরে যন্ত্রটি ঢুকে পড়েছিল আমাদের বৈঠকখানায়। টেলিভিশন। নস্ট্যালজিয়ার আরেক নাম। পঞ্চাশের দশকের ওই সময়টায় টেলিভিশন মানেই অন্যরকম কিছু। বাড়িতে টেলিভিশন থাকা মানেই সম্পদের অধিকারী হওয়া।
১৯২৫ সালের ২৫শে মার্চ জন লেগি বেয়ার্ড প্রথম টেলিভিশনের অস্তিত্ব সকলের সামনে প্রদর্শন করেন। তবে সেখানে শুধুই স্থিরচিত্রের প্রদর্শন করা হয়। ১৯২৬ সালে প্রথম গতিময় বস্তুর প্রতিচ্ছবি মানুষের সামনে তুলে ধরেন জন লেগি বেয়ার্ড। একটা সময় পর্যন্ত লন্ডন, আমেরিকার মত উন্নত দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল টেলিভিশনের অস্তিত্ব। তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও পদার্পণ করতে থাকে এই বোকা-বাক্স। ১৯৫০ সালে ভারতে এলেও শুধুমাত্র অবস্থাপন্ন বাড়িগুলিতেই দেখা যেত টেলিভিশনের অস্তিত্ব। প্রথম টেলিভিশনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পরে কেমন যেন জাদু-বাস্তবের জন্ম হয়েছিল এই যন্ত্রটির হাত ধরে। ছেলে-ছোকরা থেকে বয়স্ক, অভিজ্ঞ মানুষেরাও ভিড় জমাতেন প্রতিবেশীর বাড়িতে টেলিভিশন অর্থাৎ টিভি দেখার জন্য। শুধু তাই নয়, চাকরিক্ষেত্রে প্রোমোশন বা অন্য কোনো উন্নতি হলে আত্মীয়ের মতো বাড়িতে ঢুকে পড়ত চৌকো মত বাক্স আকৃতির টেলিভিশন। এর ভিতরে মানুষ নড়াচড়া করছে, পৃথিবীর কত গূঢ় তথ্য জানা যায়, এর উপস্থিতি ছিল ঠিক যেন সোনার কাঠির মত। জাদু হওয়ার আশা। তবে নেতিবাচক দিকও ছিল এই যন্ত্রের। তাই বলা হত বোকা-বাক্স। পরিবারের অভিভাবকরা আবার তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের এই বোকা-বাক্সের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে চলত। একদিকে যেমন টেলিভিশন মানে ছিল ম্যাজিকের ছোঁয়া, অন্যদিকে এর দ্বারা অতিরিক্ত প্রভাবিত হলে সঠিক জীবনপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। সব মিলিয়ে নানান অনুভূতির মেলা বসতো বাড়িতে টিভির উপস্থিতিতে।
তারপর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আধুনিকতার মেলবন্ধনে সাবালক হল টেলিভিশন। সাদা-কালোর পথ পেরিয়ে রঙিন ডানা মেললো সে। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে রঙিন টিভি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। যথারীতি গুটিকয়েক দেশেই প্রথমে তার চল ছিল। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে সেই সময় টেলিভিশন মানে বিলাসিতাই ছিল। তাই রঙিন টিভি ভারতে আসে আশির দশকের শুরুর দিকে। ১৯৮২ সালে প্রথম রঙিন টিভিতে সম্প্রচার হয়। সেই সময় টেলিভিশন বলতে দূরদর্শনই একাধিপত্য করত। ১৯৮২ সালের ২৫শে এপ্রিল দূরদর্শনে প্রথমবার রঙিন সম্প্রচার হয়। তখন এলসিডি, এলইডি-র ভিড় ছিল না। পাশের বাড়িতে রঙিন টেলিভিশনের উপস্থিতি রীতিমতো ঈর্ষার কারণ ছিল। টেলিভিশন যে কত দাম্পত্য কলহের জন্ম দিয়েছে, তার সীমা নেই। আবার টেলিভিশনে নির্দিষ্ট কোন অনুষ্ঠানের আনাগোনায় কত অনুভূতি প্রকাশ হয়েছে তারও কোনো হিসেব বোধহয় মানুষের কাছে নেই। সাদাকালো টেলিভিশন ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে ব্রিটেনে প্রায় ১২,০০০ সাদা-কালো টিভির লাইসেন্স নেওয়া বাকি আছে এখনো। সাদাকালো থেকে রঙিনের উত্তরণ টেলিভিশনের কাছে এক যুগের উত্তরণের সমান। কত মান-অভিমান, মনোমালিন্য, আনন্দের গল্প লুকিয়েছিল টেলিভিশনের উপস্থিতিতে। আজ আধুনিকতার পথে টেলিভিশন একটি যন্ত্র বৈ আর কিছু নয়। কিন্তু একসময় অনেকগুলো অনুভূতির ভান্ডার ছিল বোকা-বাক্স। আর তাকে মনে রাখতে এবং টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা মানুষকে সম্মান জানাতে বিশ্ব টেলিভিশন দিবস পালিত হয় প্রতিবছর ২১শে নভেম্বর দিনটিতে। নস্ট্যালজিয়া বলতে একটা চতুর্ভুজ আকৃতির বাক্স, যার মধ্যে অনুভূতিরা হাঁটাচলা করে বেড়াতে পারে, তেমন যন্ত্র টেলিভিশন ছাড়া আর কেই বা আছে।