এলসিডি টিভি তখন কল্পনার বাইরে। বাড়ির ছাদে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকত একটা সাদা অ্যান্টেনা। কাক, পাখির লাফালাফি, ঝড় বাদলা, হাওয়ার তোড়ে একেঁবেঁকে যেত তার হাত-পা। কাটা ঘুড়ি লটপট করত এরিয়ালের ফাঁকে।
টিভি এমন স্লিম ট্রিম হয়ে যায়নি এখনকার মতো। পাল্লা দেওয়া, কাঠের বক্স। যে বাড়িতেই ঢুকত পাড়ায় মর্যাদা বেড়ে যেত সেই বাড়ির। বুদ্ধিজীবী বাঙালি অবশ্য তাকে নাম দিয়েছিল ‘বোকা বাক্স’।
নীল কাচের স্ক্রিনে সাদাকালো ছবি। নব ঘোরালেই বদলে যেত তাদের রকম-সকম। কখনও বা বাংলা কখনও হিন্দিতে কথা বলে উঠত তারা। মাঝে মাঝেই টিভির বাক্স ঝাঁকিয়ে ঝিরঝির করে নাচতে থাকা পর্দায় ছবি ফিরিয়ে আনা হত। মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত।
তখনও বাঙালি বাড়িতে বৈঠক খানা ‘ড্রইংরুম’ হয়ে যায় নি। এক বাড়ির চচ্চড়ির বাটি অনায়াসে চালান হয়ে যেত অন্য বাড়িতে। লাল মেঝের টানা দালান। শতরঞ্জির প্রান্তে কোলবালিশের আয়োজন। গোটা পাড়া এক হয়ে যেত তার প্রান্তে। চপ-মুড়ি-চায়ে মজলিশি মেজাজ। এক ‘বোকা বাক্স’র টানে এক হয়ে যেত সারা পাড়া। খবর থেকে খেলা, রাজনীতি থেকে বিদেশনীতি, ইন্দিরা থেকে জ্যোতি বসু- সন্ধে সাতটায় শুনশান পাড়া। শাঁখের আওয়াজ মিলিয়ে গেলেই কথা বলে উঠত ‘টেলিভিশন’। পর্দার ওপারে কারা থাকে? কী করে ঢোকে বাক্সের ভিতর? কী করে বেরয়? কী করে কথা বলে আর কী করেই বা আমরা শুনতে পাই, যেন সমুদ্রের তলায় কোনও লুকানো রূপকথার জগৎ।
সালটা ১৯৭৫। ভারত বর্ষে তখন জরুরী অবস্থা। শ্রাবণ মাস প্রায় শেষের পথে। সে বছর স্বাধীনতার মাসে কলকাতার আর এক জানলা খুলে গেল। ৯ আগস্ট কলকাতা শহরের চোখ আটকে গেল খবরের কাগজের প্রথম পাতার শিরোনামে। ‘টেলিভিশন কামস টু দ্য গ্রান্ড ওল্ড সিটি’।
দক্ষিণ কলকাতার বন্ধ হয়ে যাওয়া রাধা স্টুডিয়োতে পথ চলা শুরু করল ‘কলকাতা টিভি’। কলকাতা দূরদর্শন তখনও ‘দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা’ নাম পায়নি।
১৯৭৬ সালে দূরদর্শনকে আকাশবানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র মাধ্যম হিসেবে দিল্লিতে আকাশবানী এবং দূরদর্শনের নিজস্ব কার্যালয়ে দু'জন পৃথক্ অধিকর্তা নিযুক্ত হন। স্বাধীন কেন্দ্র হিসেবে ‘কলকাতা টিভি’র নতুন নাম হল ‘কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্র’।
শুরু হয়েছিল পঞ্চাশ মিনিটের একটা ছোট অডিও-ভিসুয়াল দিয়ে। রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতেই সেটা রেকর্ড করা হয়েছিল৷ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় উদ্বোধন করেন কলকাতা টিভির৷ উপস্থিত ছিলেন তত্কালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল৷
১৯৮২ সালে রঙিন হল দূরদর্শন। সাদাকা্লোর পরিবর্তে রঙিন ছবি। ১৯৮৬ তে কলকাতা দূরদর্শন পুরনো রাধা স্টুডিয়ো ছেড়ে গলফ গ্রিনে চলে আসে। পয়লা জুলাই প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি উদ্বোধন করলেন কলকাতা দূরদর্শনের নিজস্ব ভবন। চালু হলো দ্বিতীয় চ্যানেল। সেই বছরেই ভারতের বাজারে শুরু হল প্রথম রঙিন টেলিভিশন বিক্রি। সে সময় ‘কলকাতা টিভি’র ডিরেক্টর ছিলেন মীরা মজুমদার।
সকাল সাড়ে ছটায় শুরু হত সম্প্রচার। রাত সাড়ে নটার ‘সংবাদ’ এর পর শেষ হয়ে যেত সম্প্রচার।
ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রসারের অন্যম শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কথা বলে উঠেছে দূরদর্শন। যার অভিপ্রায় শুধুমাত্র মানুষকে বিনোদন দান নয়। তার সঙ্গে শিক্ষা, সমাজ সচেতনতা, কৃষি স্বাস্থ্য, লোকসংস্কৃতি এবং নিজের সমকালকে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে সংরক্ষণ করা। দূরদর্শন এবং কলকাতা দূরদর্শন তাতে অনেকটাই সফল। যখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং মিডিয়ায় বাড়বাড়ন্ত হয়নি তখন দূরদর্শনই একমাত্র মাধ্যম ছিল। বঙ্গ সংস্কৃতির স্বর্ণ খনি কলকাতা দূরদর্শনের ভান্ডার।
রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রা, নেতাজীর ভাষণ, মহাত্মাগান্ধীর জমায়েত, এডমন্ড হিলারির অভিযাত্রা, মাদার টেরিসা থেকে শুরু করে দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, প্রতিমা মুখোপাধ্যায় কে নয়!
ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে দূরদর্শনের আর্কাইভ থেকে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার হয় দেখা যায় দূরদর্শন-এর আর্কাইভ থেকে। হাজার এক চ্যানেলের আর মিডিয়ার যুগেও তা কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি মানুষের কাছে। বরং রবি ঘোষ, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এর মতো দিকপাল বাঙালিদের সাদাকালো নস্ট্যালজিয়ায় দেখতে আজও দেখতে ভালবাসে মানুষ।