শিশুর প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিন

শিশুদের মনপবনের নৌকোয় যখন প্রশ্নরঙিন কৌতূহলের পাল ওঠে; তখন বড়পণ্ডিতেরা তার হাতে ভাঙা কম্পাস ধরিয়ে দেয় প্রায়শই, পাল নামিয়ে দিতে চায়, দাঁড় ছিনিয়ে নেয়-এ গল্প তারই আখ্যান।

সেই আখ্যানে বড়দের মতো বেয়াড়া-বেহদ্দ-বাহাত্তুরে-বেয়াক্কেলে আমি সাতজম্মে দেখিনি! এই আমার কথাই ধরুন না, আমি তো তখন নিতান্তই ছোটমানুষ। আমার তখন সবে পাঁচ-ছ বছরের জীবন। তখন দেখেছি, বড়রা সেই জীবনটাকে আমার চাহিদা মতো পাত্তাই দেয় না মোটে…

সেই তখন…

আমি চারপাশ দেখছি, চিনছি। আমার মনে কত্ত প্রশ্ন! কিন্তু, তার উত্তর জানব কার কাছে, বড়দের কাছেই তো? অথচ তাদের ভাবখানা দেখ, ছোটদের প্রশ্নের উত্তর সহজে দেওয়াটা যেন তাদের কাছে ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিচ্ছু না! অথচ, আমাদের বাড়ির সবাই যাকে বলে, যথেষ্ট শিক্ষিত, তা-ই।

এই দেখুন, আমাদের চকমেলানো বাড়ি। চারিদিকে ঘর, মধ্যিখানে উঠোন। উঠোনে বসে সেজকা, একটা কয়লারঙের পাথরের ওপর খানচারেক বাঁকা পেরেক হাতুড়ি দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ঘায়ে পিটছে। ঠুক ঠাক শব্দ করে কেউ কোন কাজ করলে আমার সেটা ঠায় বসে দেখতে খুব ভালো লাগে। ঐ শব্দটায় দেখতে দেখতে কেমন যেন একটা ঘোর লাগে। মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা চোরা আনন্দ হয়। কিন্তু, সেটা যে ঠিক কেমন আমি বলে বোঝাতে পারব না। শব্দ আমায় টানে, চারপাশ আমায় কৌতূহলী করে।

কৌতূহলে পায়ে পায়ে উঠোনে নামলাম। সেজকার কাছটিতে গিয়ে উবু হয়ে বসলাম। অমনি মনের মধ্যে টগবগিয়ে উঠল, পাল তুলল হাজার রকম প্রশ্ন। 'কি করছ গো, সেজকা?'-প্রশ্ন করলাম অবধারিত।

আসলে, আমার মাথা ছোট আর প্রশ্ন এত বেশি যে, কিছুতেই প্রশ্নমালা জমিয়ে রাখতে পারি না। কিন্তু, সেজকা বড় মানুষ। বড় হলে বোধহয় ছোটদের প্রশ্নে প্রথমে কান দেওয়ার নিয়ম নেই। তিনিও যথারীতি দিলেন না।

আমি কিন্তু ক্লান্তিহীন। উপেক্ষায় অভ্যস্ত। আবার প্রশ্ন করলাম, 'ও সেজকা বল না গো, কী করছ?'

সেজকার এবার ভুরু কোঁচকাল। দাঁত চেপে এবার উত্তর এল, 'দেখতেই তো পাচ্ছিস!'

হ্যাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি পেরেক ঠুকছ। কিন্তু, পেরেক ঠুকে কী করতে চাইছ, সেটা তো বুঝতে পারছি না। অথবা, আমি বুঝতে পারছি তুমি বাঁকা পেরেক সোজা করছ, কিন্তু সোজা করে কী করবে আমি সেটা শুনতে চাইছি তোমার মুখ থেকে। আমার কান যে তোমার মুখ থেকেই সব শুনতে চাইছে, এটা বুঝতে পারছ না!-কিন্তু আমার বয়স এসব বলার নয়, অনুনয় করার। আমি অনুনয় করলাম, 'বল না সেজকা! বল না!'

সেজকা তখন তার ঠোঁট দু'খানা মুড়ে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে বেশ মগ্ন হয়ে ঠুক ঠুকিয়ে ছোট ছোট ঘায়ে হাতুড়ি পিটছে। উত্তর দিল না। আমার ভেতরে কৌতূহল তখন সজোরে পাক দিচ্ছে, দিচ্ছেই…। ক্রমশ পুঞ্জীয়মান মেঘের মতো অস্বস্তি জমাট বাঁধছে। আমার বুকে ভার লাগছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি টেনে টেনে করুণ গলায় বললাম, 'ও-ও সে-জ-কা ব-ল না গো-ও!'

একবারে ভাবান্তর হল না। তাই ক’বার একটানা প্রার্থনা জানালাম।

কিন্তু একটানা সেই করুণ কণ্ঠের প্রার্থনাতে সেজকার দয়া হল না। দারুণ বিরক্তি এল। শেষমেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল, 'উফ, দেখতেই তো পাচ্ছিস পেরেক সোজা করছি!'

ঝাঁঝটা আমি ধর্তব্যেই রাখলাম না, উত্তর পেয়েছি, এতেই আমার স্বস্তি! আর তখনই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল আরেক অবাধ্য প্রশ্ন, 'পেরেক সোজা করে কী করবে সেজকা?'

এবার কাকা একবারেই উত্তর দিলেন, 'হলেই দেখতে পাবি!'

ভেতরে আবার অস্বস্তির পাক শুরু হল। কখন কী হবে, তাই দেখে তবে জানব! অতক্ষণ কৌতূহল আমি চেপে রাখব কী করে! কিছুতেই পারব না। আমি মরিয়া হয়ে বললাম, 'বলই না সেজকা, কী করবে?'

সেজকা একমনে কাজ করছে। কাজেই উত্তর দিল না, প্রশ্ন করল, 'হুঁ?'

আমি রিপিট করলাম, 'পেরেক সোজা করে কী করবে, বল না?...বল না সেজকা!'

পেরেকগুলো অনেকটা সোজা করার তৃপ্তিতে সেজকার এবার যেন ভাবান্তর হল। সেই সঙ্গে চোখে খেলল রহস্য। উত্তর দিল, 'ম্যাজিক হবে, ম্যাজিক!'

কাকার রহস্য-চোখ আমি দেখে ফেলেছি। বড়দের এই রহস্য চোখকে আমার মোটেই বিশ্বাস হয় না। তাতে শুধুই বঞ্চনা থাকে, তাচ্ছিল্য থাকে। আমার ভেতরের কৌতূহল, ধৈর্য্যহীনতা, অস্বস্তি গলাগলি করে পাক দিতে দিতে আমাকে কাঁদিয়ে ফেলতে চাইল। আমি কাঁদ কাঁদ হয়ে বললাম, 'সেজকা সত্যি করে বল না, এগুলো দিয়ে কী করবে?'

হঠাৎই কাকা যেন অহেতুক রেগে গেল, গলা তুলে সজোরে ধমকে উঠল, 'এই এখান থেকে যা তো! তখন থেকে খালি বক বক করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে!'

ভীষণ অপমানে তাড়া খাওয়া পোষা বেড়ালের মতো আমি পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। 

খানিক পরে দেখলাম, বাবা কাল যে শিবঠাকুরের ছবিটা ক্যালেন্ডার কেটে বাঁধিয়ে এনেছে, সেজকা সেই পেরেকগুলো দিয়ে বারান্দায় ওটাই টাঙাচ্ছে। এটুকু বলে দিলেই বা কী হত? উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যত কথা সেজকা বলল, তার আদ্দেক কথায় কাজ হয়ে যেত! কিন্তু, সে বললে কী আর বড়দের মান থাকে! কথার গোলকধাঁধায় ছোটদের ঘুরিয়েই তো তাদের আনন্দ! এ অভিজ্ঞতাটা আমার একদিনের, প্রতিদিনের।

আমার যখন আধো আধো বুলি ছিল, তখন আমি যা-ই বলতাম, সব্বার ভীষণ ভালো লাগত। এখন আমি যা-ই বলি-সবই ‘ফালতু বকা’, ‘অহেতুক প্রশ্ন’ বলে ওদের মনে হয়! তাই বাবা আমায় চুপ করিয়ে রাখতে চায়, মা চুপ করিয়ে রাখতে চায়, দিদি চুপ করিয়ে দিতে চায়, দাদা চুপ করিয়ে দিতে চায়, কাকারা তো বটেই, দাদু-দিদা খানিক প্রশ্রয় দেয় বটে, তবে তারাও শেষমেশ তাই।

আসলে, আমি চুপ করে মতিচ্ছন্ন বৃদ্ধের মতো শান্ত হয়ে বসে থাকলেই যেন সবাই শান্তি পায়। ধীরে ধীরে আমার মাথায় সমবেত ও পরিকল্পিতভাবে নানান ছুতোনাতায় ওরা ঢুকিয়ে দিতে থাকে যেঃ যে চুপ করে থাকে, শান্ত হয়ে থাকে, কোন প্রশ্ন না-করে গুরুজনের কথা মেনে নেয়, সে-ই হল 'লক্ষ্মী ছেলে'। সেই হয় গোপালের মতো সুবোধ বালক। নইলে ভুবনের মতো চোর হতে হয়, কানকাটা হতে হয়, জেলে যেতে হয়! পুলিশে ধরে নিয়ে যায়।

চোর আর পুলিশকে আমি ভূতের মতোই ভয় পাই। তাই ক্রমাগত ভাবতে থাকিঃ আমাকে 'লক্ষ্মী ছেলে' হতে হবে, 'গোপাল' হতে হবে। আমি ওদের কথায় বিশ্বাস করতে থাকিঃ গুরুজনদের অবাধ্য হলে ভগবান পাপ দেন! কিংবা, বেশি বক বক করলে লোকে পাগল হয়ে যায়! এমন সব কত কী!

আমার নিজস্ব যে দেশ, সমস্তটিই তো কল্পনার এক দেশ। আমি সেই দেশের রাজা। যে রাজা প্রশ্ন করে করে কৌতূহল মেটায় আর কল্পনার গায়ে বাস্তবের রঙ ধরায়। অথচ সেই কল্পলোকের রাজা হয়েও শেষমেশ এভাবেই বড়দের ইচ্ছেলোকের গোলে পড়ে গেলাম আমি। মরিয়া হলাম-ভালো যে আমায় হতেই হবে!

ব্যস, তাদের মতন করে বাধ্য বালক হলাম। ধীরে ধীরে চুপ করতে শিখে গেলাম। প্রশ্ন করতে ভুলে গেলাম। ভাবতে ভুলে গেলাম। সব মেনে নিতে শিখে গেলাম বিনা প্রশ্নে। তারই পথ বেয়ে যখন ক্লাসে যেতে শুরু করলাম, ক্লাস টিচারের 'বুঝেছিস?'-প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিতে বাধল না যে, সব বুঝে গেছি।

আসলে ততদিনে, কিচ্ছু না-বুঝলেও প্রশ্ন করে জেনে নেওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। প্রশ্নের ইচ্ছেটাকে নিজেরই বোঝা বলে মনে হতে শুরু করেছে। মনে হতে শুরু করেছে, ভাবা, প্রশ্ন করা, আবার বুঝতে চাওয়া-এ বড় ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। মনে হতে শুরু করেছে যে, ক্লাসে প্রশ্ন করলে টিচার যদি বিরক্ত হন, সবাই যদি বোকা ভাবে!

আসলে আমার অতিপ্রিয় পরিজনেরা, যারা আমায় 'সোনা-মোনা'-বলে আদর করে, আমার জন্মদিন মনে রাখে, সেলিব্রেট করে, উইশ করে, আমার 'ফেভারিট'-এর লিস্টি যাদের মুখস্ত-তারাই তিলে তিলে আমার প্রশ্নাতুর মনটাকে নষ্ট করে দিয়েছে।

এতদিনে তারা আমায় সত্যিই তাদের ভাবগণ্ডিতে আমায় বেঁধে ফেলতে পেরেছে, পরিবারের বাধ্য করে তুলতে পেরেছে, করে তুলতে পেরেছে তাদের মতোই একজন বাধ্য নাগরিক। পরিবার-রাষ্ট্র-অধিকার-স্বাধীনতা-বঞ্চনা কোন কিছু নিয়েই আজ আমি কোন প্রশ্ন তুলি না। তোমরা শুনে খুশি হবে যে, কেউ বিরক্ত হয়, অস্বস্তিতে পড়ে, রেগে যায়-এমনধারার প্রশ্ন করতে আমি সত্যিই ভুলে গেছি!

আসলে আমি বলতে চাইছি, মরা পাতা ঝরে বসন্তের গাছে আবার নতুন পাতা আসে। কিন্তু, সেই কবেকার ছোট্ট রাজার মরে যাওয়া মনে সহজে আর বসন্ত আসে না...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...