আমি তখন বেশ ছোটো, সালটা ঠিক মনে নেই, দিনটা শনিবার ছিল। এমনই কোনো এক শীতের দুপুরবেলা বসে মা এর কাছে গল্প শুনতাম। মহাপুরুষ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বড়-বড় বিজ্ঞানীদের জীবনী আরো কত কি। গল্পের শেষে মা বলতেন কাজ এমন কিছু কোরো যাতে মানুষ তোমার জীবনী লিখে রাখে। আজ অফিসের শেষে ট্যাক্সি করে যখন বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ ট্যাক্সি চালক বলে উঠলেন কোথায় নামবেন আজ বাড়ি-নাকি খোকন দার চায়ের দোকানে। আরে দাদা খেয়ালই করিনি আপনি, মোবাইলে ব্যস্ত থাকলে যা হয়, আপনার গাড়িতে এর আগেও এসেছি না? তারপর কেমন আছেন বলে গপ্পো জুড়ে দিলাম। ভদ্রলোকের কথাবার্তা বেশ ভালো, ওনার নাম জালালউদ্দীন গাজী, বাড়ি জয়নগর। মোয়ার দৌলতে সকলেই আমার মতো জায়গাটার নামের সাথে পরিচিত আশা করি।
ট্রেন থেকে জয়নগর স্টেশনে নেমে মোটরভ্যানে করে কিলোমিটার তিনেক যেতে হয়, না না মোয়া কিনতে নয় ওনার তৈরী স্কুলে পৌঁছতে। ভদ্রলোকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ক্লাস টু পর্যন্ত হলেও মানসিক দিক থেকে পড়াশুনার স্তর আকাশ ছুঁয়েছে। বাড়িতে স্ত্রী, দুইছেলে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি নিয়ে বেশ বড় সংসার। আর সকলেই আই আই পিএফ স্কুলের উন্নতির জন্য খুবই সচেষ্ট। বর্তমানে স্কুলের তিনটি দালান আছে, যার মধ্যে ওনার টালির ঘরটিও বাদ পড়েনি। যা বতর্মানে স্কুলের হেঁসেল এবং দুপুরে ওখান থেকেই বিনা-পয়সায় সুষম আহার বিতরণ করা হয়। প্রথম দিকে শুধু প্রাথমিক পর্যন্ত পড়ানো হত স্কুলে এখন মাধ্যমিক স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। এখন স্কুলে ৪২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে এবং ২৫ জন শিক্ষা কর্মী কাজ করে।
নিজের ট্যাক্সির গায়েই লিখে রেখেছেন তাঁর ফোন নম্বর এবং তাঁর স্কুলের নাম। শিক্ষায়তন মিশনের মাধ্যমে যখন স্কুলটি তিনি খোলেন তখন শুধু নিজের ট্যাক্সি চালানোর টাকা দিয়ে চলত স্কুল। তারপর সহৃদয় ব্যক্তিরা তার ট্যাক্সির গায়ে থাকা বার্তাটি পড়ে এগিয়ে আসেন তাঁর সাহায্যার্থে। এই করেই দীর্ঘ পথ চলা। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন সন্মানও পান তিনি। অতি সম্প্রতি 'কৌন বনেগা কড়োরপতি'তে অমিতাভ বচ্চনের মুখোমুখি বসে একের পর এক জবাবের তুখোড় উত্তর দিয়ে ২৫ লক্ষ টাকাও জেতেন। সেই সমস্ত টাকাই দিয়ে দেন নিজের স্কুলের উন্নয়ন তহবিলে। এলাকার মানুষের কাছে তিনিই ভগবান তিনিই সরস্বতীর আরও এক রুপ। জালালুদ্দিন গাজি বলেন যে ‘আমি যত টাকা উপার্জন করেছি তা দিয়ে হয়তো নিজের জীবনকে আরও সুন্দর করে সাজাতে পারতাম। কিন্তু সুখ হয়তো পেতাম না। নিজের বাড়িতে আমরা খুব কষ্টেই থাকি তবুও এলাকার বাচ্চাগুলো ত একটু পড়তে পারছে! ওরা বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হলেই আমার জীবন সার্থক।’ তাঁর পাশে বসে মৃদু হাসেন তাঁর গৃহিনী।
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে যখন মানুষ প্রতি মুহুর্তে লড়াই করে জীবন জীবিকার জন্য, তখন গাজী জালালউদ্দিনের মতো মানুষই এঁকে দেয় ছোট্টো জীবনে বড় হয়ে বাঁচার স্বপ্ন।