চলে গেলেন তরুণ মজুমদার, বাঙালির নিজের পরিচালক তিনি। তাঁর ছবি মানে পরিবারের সকলে মিলে বসে সিনেমা দেখা। তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই সাহিত্যনির্ভর ছবি, সেটা ভালবাসার বাড়ি হোক বা দাদার কীর্তি।
১৯৩১ সালে ওপার বাংলার বগুড়ায় তরুণ মজুমদারের জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা, বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। নিজের মতো খুব সাধারণ ছবিই বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। চ্যাপলিনের ছবি খুব অনুপ্রাণিত করত। ছোটবেলা থেকেই ছবির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। ছবির প্রতি এমন আকর্ষণ তাঁকে টেনে নিয়ে গেল ছবির দুনিয়ায়। চোদ্দো বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়। সেন্ট পলস কলেজে ভর্তি হন, সেন্ট পলসে আইএসসি শেষ করে, স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক। ফিল্মের নেশাটা ছিলই। কলকাতায় আসার পরে যা জাঁকিয়ে বসল।
দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর শচীন মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে যাত্রিক গড়লেন। ১৯৫৯ সালে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত চাওয়া পাওয়া তরুণ মজুমদারদেরর প্রথম পরিচালিত ছবি। ১৯৬০ যাত্রিক তৈরি করল স্মৃতিটুকু থাক। ১৯৬৩-তে যাত্রিক আরও দুটি হিট ছবি উপহার দেয়, পলাতক ও কাঁচের স্বর্গ। কাঁচের স্বর্গ জাতীয় পুরস্কার পায়। ১৯৬৫ সাল থেকে যাত্রিক থেকে বেরিয়ে এসে তরুণবাবু নিজে পরিচালনা শুরু করেন, ছবির নাম ছিল আলোর পিপাসা।
এরপর একের পর এক ছবি একটুকু বাসা, পলাতক, বালিকা বধূ, আগমন, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, কুহেলী, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসা, আপন আমার আপন, পথ ভোলা, পথ ও প্রসাদ, আলো, চাঁদের বাড়ি, ভালোবাসার অনেক নাম, বক্সঅফিস কখনও মুখ ফেরায়নি। সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির 'হিট' পরিচালক বললে তিনিই। প্রচেত গুপ্তর লেখা ভালবাসার বাড়ি নিয়ে ২০১৮ সালে ছবি বানিয়েছিলেন। ওটাই তাঁর শেষ কাজ হয়ে রইল। এর মাঝেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দুর্গেশনন্দিনী' গল্প অবলম্বনে ২০১৪ সালে তৈরি করেফেলেছিলেন জীবনের প্রথম ধারাবাহিক।
সমসাময়িক অন্যান্য চলচ্চিত্রকার যেমন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমুখ পরিচালকদের মধ্যেও তিনি নিজের মতো করে উজ্জ্বল। নিয়মিতভাবে বক্স অফিস হিট ছবি নির্মাণ করে গিয়েছেন। চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি বি.এফ.জে.এ. সম্মান, পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একটি আনন্দলোক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৯০ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার।
প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অসংখ্য ছবি তৈরি করে বাঙালি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। পল্লীগ্রাম, পুকুর, মেঠোফুল, গ্রাম্য জীবন ভাল থাকুক তরুণ মজুমদারের ছবিতে। ২০০০ সাল থেকে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় কদিন আগেই তাঁকে এসএসকেএম-এ ভর্তি করা হয়। কদিনের লড়াই শেষ হল, শেষ রক্ষা হল না। চলে গেলেন বাঙালির পরিচালক। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তাঁর ছবির মতোই আজ থেকে তিনিও ফেলে আসা সময়ের মানুষ হলেন।