গোড়াতেই বলব, যা ঘটছে বা যা ঘটানো হচ্ছে তা তুলে ধরা যেমন জরুরী, যা ঘটছেনা বা যা ঘটে গেছে তার পুনরাবৃত্তিও কিন্তু সময়ের নিরীখেই একান্ত জরুরী। এই দু’য়েরই এক অসামান্য মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই ছবিতে।
মুক্তচিন্তা-স্বাধীকার-আদর্শ-আন্দোলন-ছাত্র চেতনা- শিল্প-দর্শন এই সবকিছুকেই একেবারে নতুন ছাঁচে ফেলে একটা সমসাময়িক গল্প বেঁধেছেন চূর্ণী। একজন আদর্শবাদী মানুষ অরিন্দম(শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়), সেইই এই গল্পের প্রটাগনিস্ট। তাঁর জীবনাদর্শ ও ব্যাক্তিগত টানাপোড়েনেই বেড়ে উঠেছে চিত্রনাট্য। প্রথাগত কোনওকিছুকেই মেনে নিয়ে চলতে পারেনা অরিন্দম, গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া যে প্রজন্মের কাছে আন্দোলন-দর্শন-আদর্শবোধ সবকিছুই যুক্তিহীন-ভিত্তিহীন, সেই প্রজন্মের কথা ভেবে বিচলিত সে এবং মনে প্রানে চায় সুচিন্তক হয়ে উঠুক নবপ্রজন্মের ছাত্রদল, অন্যায়-অবিচারে সবাই যখন চুপ, অরিন্দম সবকিছুকে উপেক্ষা করে গর্জে ওঠে প্রতিবাদে এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে সে সুখী, আবার নয়ও, কারণ সে জানে তাঁর স্ত্রী ইরা(রাইমা সেন) একাকিত্ব কাটাতে ভরসা করে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুদ্র’র(ঋত্বিক চক্রবর্তী) উপর। ইরা সাধারণ মেয়ে, যার জগৎ সুখী পরিবার-স্বামী-সন্তান-আবেগের চেনা পরিসরে বাঁধা। একজন শিক্ষিত মহিলার এহেন চিন্তাভাবনা পীড়িত করে অরিন্দমকে। রুদ্র’র চরিত্রটা অনেকটা ভবঘুরের মতো, কোনও কিছুতেই স্থির হয়ে থাকতে পারেনা সে, তাই সংসারও করে উঠতে পারেনা সে, তার যতটুকু সংসারী আবেগ তা সে ভাগ করে নিতে চায় বন্ধু অরিন্দমের সংসারের সঙ্গেই। অরিন্দমের ছোট্ট মেয়ে নীহারিকা, যাকে নিয়ে অরিন্দমের অনেক স্বপ্ন, সেই ‘নিন্নি’ও বাবার থেকে বেশি কাছে পায় রুদ্র’কে। সব থাকতেও ধীরে ধীরে একা হয়ে যেতে থাকে অরিন্দম, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ঠিক যেমনভাবে একাকিত্বে ভুগতে থাকে শিল্প- বিপ্লব-বিবেক। অরিন্দম তাই মাঝেমধ্যেই পালিয়ে যেতে চায়, পেশায় অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে সে সুযোগও পেয়ে যায় সে কারণ ‘স্পেশাল স্পিচ’ দিতে স্থাপত্য-শিল্পের চারণভূমি- লন্ডনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হয় তাঁকে। ২০১৫ থেকে ২০১৮, এই তিন বছর ধরে নিজের জন্মদিনটাও সেখানে একা একা বা খুব কাছের পরিচিত মানুষের সঙ্গে কাটায় সে। অরিন্দমের সেই কাছের পরিচিত মানুষগুলোর একজন, যাঁর নাম ঘুরে ঘুরে আসে এই ছবিতে, তিনি হলেন এক বিদেশিনী- জর্জিনা। ছবির গল্পের একেবারে শেষ মোচড় তিনিই।
২০১৫ থেকে ২০১৮, মোটামুটি এই তিনবছরে অরিন্দমের ফেসবুক টাইমলাইন’-এর ‘তারিখ’ ধরেই এগিয়ে চলে গল্প। এই ছবির যেটা মূল পাওনা তা হল ‘স্বচ্ছতা’, তা সে গল্প বলায় হোক, অভিনয়ে হোক, অথবা পরিচালকের ভাবনায়, সবেতেই পরিস্কার-চাঁচাছোলা বক্তব্য রাখা হয়েছে। গান ব্যবহার নিয়ে আলাদা করে কিছুই বলার নেই। সব মিলিয়ে অন্য সব ছবির ভিড়ে এই ছবিকে আলাদা করে তাই চিনে নেওয়াই যায়।