কলকাতার অনন্য এক মন্দির, তারাশঙ্করী পীঠে

কলকাতার শ্যামবাজার থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলের জাগ্রত এক সুবিশাল মন্দির। প্রচারের আড়ালে, নিভৃতে বহু বছর ধরে তন্ত্রমতে পূজিত হচ্ছেন মা তারা। নাম 'তারাশঙ্করী পীঠ'। বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে তারাশঙ্করী পীঠে।

এই মন্দিরের নির্মাণশৈলী এবং বিগ্রহের সহাবস্থান অদ্ভুত। মন্দিরে দেবী কালিকা, যশােমাধব এবং কালভৈরবের মূর্তি দেখা যায়। মন্দিরে প্রবেশ করার পরই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী পরেশচন্দ্র রায়মৌলিক এবং তার স্ত্রী শ্রীমতী অঞ্জলি রায়মৌলিকের সমাধি মন্দির দেখা যায়। ডান দিকে চোখে পড়ে বিখ্যাত যশােমাধবের রথ। সামনের সিঁড়ি পেরিয়েই গর্ভগৃহ। সেখানে দেবী তারাশঙ্করী বসে আছেন শিবের ওপর। 

এই গর্ভগৃহে শ্মশানের পােড়া কাঠে সারাক্ষণ আগুন জ্বলে। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় বারাণসীর মণিকর্নিকা মহাশ্মশান থেকে সধবার চিতার আগুন আনা হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত জ্বলছে চিতার আগুন। এখনও কলকাতার নিমতলা শ্মশান থেকে চিতার আধপোড়া কাঠ আসে 'তারাশঙ্করী পীঠ'-এ। সেই কাঠেই জ্বলছে সধবার চিতার আগুন। গর্ভগৃহের মধ্যে, দেবীর সামনে মরার মাথার খুলি, হাড় প্রভৃতি টাঙানাে রয়েছে। রয়েছে এক বিশাল উঁচু বেদি এবং তার ওপর ত্রিশূল। ত্রিশূলে গাঁথা রয়েছে রুদ্রাক্ষ। সাদা শিবলিঙ্গ এবং ফণা তােলা ধাতব সাপ। দেবী তারাশঙ্করীর মূর্তি দর্শন ভয় সঞ্চার করে। দেবীর চোখে উগ্রতা, দাঁত প্রকটভাবে দৃশ্যমান এবং রক্তস্নাত। ডান হাতে খাঁড়া, কাটারি ও বাঁ হাতে রুপাের নরমুণ্ড, বরাভয়। দেবীর গায়ের রং নীলচে আকাশি। চতুর্ভুজা দেবী তারাশঙ্করীর দেহের পূর্ণ অবয়ব দৃশ্যমান নয়। একমাত্র কালীপুজার দিন এবং কার্তিকী অমাবস্যায় গর্ভগৃহে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে দশমহাবিদ্যার মূর্তি দেখা যায়। গর্ভগৃহের সামনে চাতাল এবং তার নীচে হাঁড়িকাঠ।

মা তারাই এখানে 'তারাশঙ্করী' নামে পূজিত হন। দেবীর এক অঙ্গে রয়েছে তিন রূপ- উগ্র তারা, একজটা তারা এবং নীল সরস্বতী।

'তারাশঙ্করী পীঠ'-এর আকর্ষণ হল 'নবমুণ্ডি আসন'। বাঘ, হাতি, শেয়াল, সাপ, অপঘাতে মৃত ব্যক্তি, চণ্ডাল ইত্যাদির ৯টি মাথার খুলি দিয়ে সজ্জিত আসন। 

প্রতিদিন 'মা তারাশঙ্করী'র নিত্য পুজো হয়। পুজোতে দেবীকে দেওয়া হয় আমিষ ভোগ। পাতে থাকে অন্ন, ডাল, সবজি, পাঁচ রকমের ভাজা, মাছ, চাটনি এবং পায়েস। অমাবস্যা, কালীপুজোয় থাকে বিশেষ ভোগ। এই মন্দিরেই পূজিত হন যশমাধব। বাংলাদেশের ধামরাই জেলা থেকে তাঁকে আনেন যোগী মহারাজ পরেশচন্দ্র রায় মৌলিক। এক কোটি তুলসি পাতা দিয়ে যশমাধবের শালগ্রাম শিলা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যশমাধবের মূর্তি নিমদারু কাঠের তৈরি। নিত্য পুজোয় যশমাধবকে দেওয়া হয় নিরামিষ ভোগ।

একই সঙ্গে 'তারাশঙ্করী পীঠ'-এ পূজিত হন কালভৈরবও। ত্রিদেবকে পরাজিত করেছেন তিনি। তাঁর একহাতে ব্রহ্মার মুণ্ড, আর এক হাতে খর্গ, বাকি দু'টোয় বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র ও শিবের ত্রিশূল। পদতলে শায়িত মহাদেব। নেপাল ছাড়া ভারতের একমাত্র এই মন্দিরেই মূর্তিরূপে পূজিত হন মহাকাল। এই তারাশঙ্করী পীঠে যে মহাকাল বিগ্রহ রয়েছে, ভারতবর্ষের অন্য কোথাও আজ আর বিশেষ দেখা যায় না। 

মন্দিরটির ত্রিতলবিশিষ্ট। প্রথমতলে দেবী তারাশঙ্করীর অবস্থান। দ্বিতীয়তলে রয়েছেন শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ যশােমাধব। গর্ভগৃহের বাইরের চাতাল থেকে যশােমাধবের দর্শন হয়। এখানে রাধাকৃষ্ণ মূর্তিরও পুজো করা হয়। শীর্ষে অর্থাৎ তৃতীয়তলে অবস্থান করছেন শ্রীকালভৈরব। মহাকাল রূপে তিনি এখানে বিরাজমান। ভৈরবের ছয়টি হাত। ডানদিকের তিনটি হাতে ধরে আছেন খড়গ, মুদ্রা ও কালদণ্ড। বাঁদিকের তিনটি হাতে রয়েছে চক্র, মুদ্রা ও কাটা নরমুণ্ড। মহাকাল মূর্তি যেন প্রলয়ঙ্কর রুদ্ররূপের প্রকাশ। সাদা ও কালাে। যাঁড়ের মূর্তিও দেখা যায়। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রতিভূ বারােটি সাদা শিবলিঙ্গও রয়েছে এখানে। মহাকাল দাঁড়িয়ে রয়েছেন একটি নিকষ কালাে পাথরের ওপর। সব মিলিয়ে এই মন্দিরের পরিবেশ ও প্রকৃতি অন্যান্য মন্দিরের চেয়ে অনেকাংশে পৃথক।

এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে অনেক গল্প। উড়িষ্যার জগন্নাথধামে এই গল্পের সূত্রপাত। উকলরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর জগন্নাথদেবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রভাসে শ্রীকৃষ্ণের শরীর দাহ করার পর অবশিষ্ট অংশ ভাসতে ভাসতে পুরীর সমুদ্রতীরে আসে। সেই নিমকাঠ দিয়ে মূর্তি বানান দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। শর্ত ছিল, কেউ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না মূর্তি তৈরি শেষ হচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছু কাল পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আর কৌতূহলবশত মন্দিরে প্রবেশ করেন। শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় শিল্পী মূর্তিনির্মাণ অসমাপ্ত রেখেই চলে যান। কিন্তু এর পরের ঘটনা...

বিশ্বকর্মা চলে এসেছেন, সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু উদ্বৃত্ত কাঠ। সেই কাঠ দিয়ে তৈরি করলেন নীলমাধবের মূর্তি। লােকচক্ষুর সম্মুখে এই মূর্তি আনা যাবে না, কারণ তিনি শর্তভঙ্গ করেই এই মূর্তি নির্মাণ করলেন। তাই তিনি নীলমাধবের মূর্তি মাটির নীচে প্রতিষ্ঠা করে চলে গেলেন। সেই অপূর্ব বিগ্রহ বন্দী পড়ে রইল পাতালে। এর বেশ কিছুকাল পরের ঘটনা। পালবংশের রাজা যশােপাল শ্বেতহস্তীর পিঠে চেপে ভােরবেলায় বেরিয়েছেন পথ পরিক্রমায়। হাতি এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। শত প্রচেষ্টাতেও তাকে নড়ানাে গেল না। রাজা তখন হাতি থেকে নেমে এসে আদেশ দিলেন, ওই তূপ ভাঙতে হবে। ওই অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে দেখারও নির্দেশ দিলেন। এই সময় হাতিটি বারংবার সেই স্তৃপটিকে প্রণাম জানাতে লাগল। মাটি খোঁড়া শুরু হল। কিছুই পাওয়া গেল না। সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এমন সময় ঘটল আরও এক ঘটনা। এক সুদর্শন মানুষ এসে রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। রাজা দেখা করলেন। জানা গেল, ব্যক্তিটি একজন শিল্পী। তিনি রাজাকে অনুরােধ করলেন, যেন অবিলম্বে মাটি খোঁড়া বন্ধ করা হয়। এও জানালেন যে, এর আগেও যাঁরাই এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই জীবন বিপন্ন হয়েছে। 

এরপরই জগন্নাথদেবের মূর্তি এবং তারপর অবশিষ্ট কাঠ দিয়ে নীলমাধবের মূর্তি তৈরির কাহিনী শােনালেন ওই শিল্পী। আরও বললেন যে, এই মাটির নীচেই আছেন নীলমাধব। আর তাঁকে পুরুষানুক্রমে পাহারা দিচ্ছেন এই শিল্পী। অতীতেও তিনি বহু খননকারীকে সতর্ক করেছেন এই স্তৃপ যাতে না খোঁড়া হয়, কারণ নীলমাধবকে যে পাবে, তাকে সর্বস্ব হারাতে হবে। সুতরাং রাজাও যেন এই মাটি খোঁড়া থেকে নিরস্ত থাকেন। রাজা সব কথা শােনার পর কয়েক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে ভাবলেন। তিনি ঠিক করলেন, এই নীলমাধবকে তার কাছে পেতেই হবে। তিনি পুনরায় খননকার্য চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। রাত শেষে ভোর হচ্ছে। তখন মাটির নীচ থেকে দৃশ্যমান হল একটি ঘর। রাজা স্বয়ং সেই ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের ভেতর আবিষ্কৃত হল আরও একটি ঘর। তার মধ্যে মন্দির। মন্দিরে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম হাতে চতুর্ভুজ নীলমাধব নারায়ণ। রাজা লুটিয়ে পড়লেন শ্রীবিষ্ণুর পায়ে।

এরপরে নেমে আসে বিপর্যয়। যশােপালের অর্থ, প্রতিপত্তি, সব হারিয়ে যায়। শুধু রয়ে যায় নাম। প্রভুর নামের সঙ্গে জুড়ে যায় রাজার নাম। নীলমাধবের নতুন নাম হয় যশােমাধব। এরপর একদিন কালের নিয়মেই পাল বংশ শেষ হয়ে যায় এবং যশােমাধবের মন্দিরও চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। সেনহাটির ধুলাে পড়া যশােমাধবের মন্দিরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন সখিপুরের জমিদার রামজীবন রায়মৌলিক। সম্ভবত ১৫৮৫ সালে রামজীবন স্বপ্নে যশােমাধবকে পেয়েছিলেন বলে শােনা যায়। তিনি সেনহাটি থেকে যশােমাধবকে নিয়ে আসেন সখিপুরে। সেখানে শুরু করেন যশােমাধবের রথযাত্রা। ৮০ ফুট উঁচু সেই রথ টানতে লাগত ৮০ মণ পাটের দড়ি। 

এর অনেক পরে রামজীবনের নবম পুরুষ পরেশচন্দ্র রায়মৌলিক কলকাতার বেলগাছিয়ায় এসে পড়েন। সেখানকার রেল কলােনিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন সিদ্ধযােগী পুরুষ। বেলগাছিয়ার দক্ষিণদাঁড়ি রেল কলােনিতে এক পবিত্র ভূমিতে তিনি খুঁজে পেলেন এক নির্জন স্থান। বট-অশ্বথে ঘেরা জায়গাটি সাধনার উপযুক্ত স্থান বলে মনে করলেন তিনি। এখানেই তিনি গড়ে তুললেন তারাশঙ্করী পীঠ। এরপর সাধক পরেশচন্দ্র নতুন করে রথযাত্রার সূচনা করেন। প্রায় ৩০ ফুট উঁচু এখানকার রথ। এই মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।​

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...