বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে অন্যতম, যিনি উপন্যাস এবং ছোটগল্পের ধারাকে বাস্তবময়তা থেকে রোম্যান্টিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহন করেন আজকের দিনটিতেই অর্থাৎ ২৩ জুলাই । সেই সংগ্রামী লেখকের ১২১ তম জন্মবার্ষিকী আজ।
আমাদের অস্থির,সংশয়-বিক্ষুব্ধ ,অবিশ্বাসী যুগের প্রধান কথাশিল্পী তারাশঙ্কর তার জীবনে দেখেছেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন,অহিংস আন্দোলন, সাম্যবাদী আন্দোলন, ৪২-এর সংগ্রাম, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও দেশবিভাগ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ভাষা আন্দোলন। সেই সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভীক্ষ মহামারী, মন্বন্তর, উদ্বাস্তু সমস্যা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্ম নেন তারাশঙ্কর। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর পিসিমা চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর জমিদার হয়ে উঠুক কিন্তু তাঁর মা চাইতেন ছেলে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে স্বনির্ভর এবং স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠুক। ছোটবেলা থেকেই ঘন ঘন ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী তারাশঙ্কর প্রথমবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে না পারলেও দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হন। এরপর কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বহরমপুর যান এবং সেখানে স্থান না পেয়ে প্রথমবার কলকাতায় আসেন এবং বিভিন্ন কলেজে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কলেজের অধ্যয়ন শেষ করতে হয় তাঁকে, কারন তখন তিনি বিপ্লবী সংগঠনে যুক্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে ইংরেজ শাসকদের নজরে পড়ে তাঁকে কিছুদিন গৃহবন্দীও থাকতে হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বন্দীদশার অবসান হলে তিনি সাউথ সুবারবান(আশুতোষ কলেজ) কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ম্যালেরিয়ার প্রকোপে পড়াশোনা বন্ধ করে তাঁকে লাভপুরে ফিরে আসতে হয়। এই সময় উমাশশীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু তাঁর কথা অনুযায়ী, তাঁর দাম্পত্যজীবন ছিল কলহ ও বিমর্ষতায় ভরা।
যৌবনে তারাশঙ্কর প্রভাবিত হয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের আদর্শের দ্বারা। গ্রামের সমাজসেবক সমিতির উদ্যোগে মুষ্ঠিভিক্ষাসংগ্রহ, অগ্নিনির্বাপনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন ও সাধারন মানুষের সেবায় ব্রতী হন। এরই পাশে সমান্তরালভাবে ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। সশস্ত্র বিপ্লব বা হিংসাত্মক বিপ্লবীদের পথ থেকে অচিরেই সরে এসে তিনি যুক্ত হন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে। অসহযোগ আন্দোলনের পর ১৯৩০ সালে আইনঅমান্য আন্দোলনে সক্রিয় যোগদানের জন্য তিনি ছ’মাস কারারূদ্ধ থাকেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন 'সাহিত্যসেবার পথেই দেশের সেবা'।
তারাশঙ্কর উপন্যাস লিখেছেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এবং তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ষাট। প্রথম উপন্যাস 'চৈতালী ঘূর্নী' প্রকাশিত হয় 1931 সালে এবং শেষ উপন্যাস 'নবদীগন্ত' প্রকাশ পায় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য - পাষানপূরী(1933), নীলকন্ঠ(1933), রাইকমল(1934), প্রেম ও প্রয়োজন(1935), ধাত্রীদেবতা(1939),গনদেবতা(1942), কবি(1944), হাসুলি বাঁকের উপকথা(1947), আরোগ্যনিকেতন(1953), সপ্তপদী(1957), মহাশ্বেতা(1960), যোগভ্রষ্ট(1960), কালবৈশাখী(1963), ভূবনপুরের হাট(1964),ইত্যাদী।
তারাশঙ্করের জনপ্রিয়তার প্রধান কারন হিসেবে বলা যেতে পারে, বাংলার আঞ্চলিক জীবনকে ব্যাপকভাবে উপন্যাসে টেনে আনা এবং ছোট গল্পগুলোতে তুলে ধরা। তাই বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করা হয় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে। বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলের বিচিত্র পরিবেশের মধ্যেই তাঁর শৈশব, বাল্য, এবং কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছিল। ফলত এখানের ভূ-প্রকৃতি, আড়ম্বরহীন জনজীবন এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির উপাদান হিসেবে স্থান পেয়েছে।
তাঁর মতে মানুষের লক্ষ্য শুধু দেশের রাজনৈতিক মুক্তি বা অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, ভয় থেকে, হীনতা থেকে ও দৈন্যতা থেকে মুক্তি। তাঁর সাহিত্য সাধনায় তিনি খুজেছেন অখন্ড মনুষ্যত্বকে এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ককে।
১৯৩৪ সালের কল্লোল পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় তার প্রথম ছোটগল্প 'রসকলি'প্রকাশিত হয়। তিনি বলেছিলেন বিদ্রোহ এবং বিপ্লবে প্রভেদ আছে। তাঁর রচনার সমাপ্তি-পদ্ধতি বিশ্লেষন করলে বোঝা যায়, তাঁর রচনার ভেতর ভেঙে নতুন করে গড়ার গভীর স্বপ্ন ছিল। তার রচিত গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম-রসকলি, মালাচন্দন, হারানো সুর, জলসাঘর, রায়বাড়ী, কুলীনের মেয়ে, মধুমাষ্টার, ব্যাধী, বিষধর, রঙীন চশমা, অগ্রদানী, তারিনীমাঝি, বেদেনী, ব্যার্ঘচর্ম, মরামাটি, অহেতুক, শেষকথা, মতিলাল, কালাপাহাড়, দেবতার ব্যাধি, ইমারত প্রভৃতি। তাঁর গল্পগুলিতে অন্তজ শ্রেনীর চরিত্ররা বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত 'ডাইনী' গল্পটি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল।
১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে বাগবাজারে একটা বাড়ী ভাড়া নিয়ে সপরিবারে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৪১ সালে উত্তর কলকাতার বরানগরের একটা বাড়ীতে উঠে এসেছিলেন। তারপর ১৯৪৮ সালে টালা পার্কের বাড়ীতে তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন । ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ দান করে। ১৯৫৯ সালে জগত্তারিনী গোল্ড মেডেল পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে। ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ অনুসারে তিনি রাজ্যসভার সদস্যপদ গ্রহন করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই সদস্যপদ থেকে নির্বাসন নেন। ১৯৬২ সালে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করা হয় ও ১৯৬৯ সালে তিনি লাভ করেন ‘পদ্মভূষন’ উপাধী। ওই একই সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডক্টর অফ লিটেরেচার’ সম্মান প্রদান করে এবং সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে ফেলোশিপ পান।
১৯৭০ এ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৭১ এ তাঁর মৃত্যু হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনের জন্য। উত্তর কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে তার শেষঃকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছিল। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের শিল্পীরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখা ‘জলসাঘর’ এবং ‘অশনি সংকেত’ গল্প দু’টিকে সার্থক চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
সাহিত্যজগতে তাঁর পদার্পনের আগেই বাস্তবধর্মী উপন্যাসের ধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল রবীন্দ্র, বঙ্কিম এবং শরৎচন্দ্রের সৃষ্টির মাধ্যমে। বিংশ শতকের যে লেখকেরা সাহিত্যের কাব্যময়তাকে ভেঙে জীবনের প্রতক্ষ অভিজ্ঞতাকে লেখায় স্থান দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
সারাজীবন তিনি নিজে যা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন সেইগুলোই লিখেছেন শুধু। সে সময়ের তথাকথিত সংকীর্ন মানবচিন্তাকে উপলব্ধী করে তিনি চেয়েছিলেন, দ্বিধা-দ্বিচারিতা অপসারিত হয়ে এক স্পষ্টবাদী , স্বাধীন, উদারমনস্ক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক।