আজীবন গভীর চিন্তন, নিগূঢ় দর্শন আর লাল রঙের মাটি দিয়েই সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন তারাশঙ্কর

তাঁর ‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থের প্রথমদিকে লিখেছেন, ‘আমার জীবনের প্রথম রচিত কবিতা খড়ি দিয়ে লিখেছিলাম আমাদের বৈঠকখানা বাড়ির একটি খড়খড়িওয়ালা দরোজার গায়ে। তখন বয়স আমার সাত বছর। আটে পড়েছি। আমার দরজায় লেখা কবিতাটি কিন্তু ব্যঙ্গ কবিতা নয়। যাকে বলে জাত কবিতা, তাই দস্তুর মতো করুণরস অবলম্বন করে লেখা। তিন বন্ধুতে খেলা করছিলাম, হঠাৎ আমাদের বৈঠকখানার সামনের বাগানে একটা গাছের ডালে পাখির বাসা থেকে একটি পাখির বাচ্চা মাটিতে পড়ে গেল। তিন বন্ধুতে ছুটে গিয়ে তাকে সযত্নে তুলে এনে বাঁচাবার এমনই মারাত্মক চেষ্টা করলাম যে, বাচ্চাটি বারকয়েক খাবি খেয়েই মরে গেল। বালক মনে একটি করুণরসের ধারা সঞ্চারিত করে গেল। আমার সঙ্গীদের মধ্যে একজন ছিল পাঁচু। সে একটা খড়ি দিয়ে আমাদের দরজায় খণ্ড খণ্ড করে দুই লাইন কবিতা রচনা করে ফেলল। আমিও পাঁচুর খড়িটি নিয়ে পাঁচুর কবিতা নিয়ে লিখলাম—

‘পাখির ছানা মরে গিয়েছে

মা ডেকে ফিরে গিয়েছে

মাটির তলা দিলাম সমাধি

আমরাও সবই মিলিয়া কাঁদি।’

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবেই শুরু থেকে তাঁর লেখার ভাবে ধরা পড়েছিল গভীর চিন্তন, নিগূঢ় দর্শন; তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তাঁর সব লেখায় মানবিক মহত্ত্ব ধরা পড়েছে সাবলীলভাবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের কামনা বাসনাকে অনন্য গদ্য ভাষা দিয়েছেন তিনি । তাঁর সেই গদ্য ভাষা বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রবাহধারা এনে দিয়েছিল। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তার একাধিক গল্প, নাটক ও উপন্যাসের বিষয়বস্তু। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। সেখানে আরও আছে গ্রাম্যজীবনের ভাঙনের কথা, নগরজীবনের বিকাশের কথা।

১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন। ওই বছর তার প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ প্রকাশ হয়। ১৯৪২-এর বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংগঠনের সভাপতি হন। বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তারাশঙ্করের লেখনীর স্পর্শে বাংলা কথাসাহিত্য আবার নতুনভাবে আলোকিত হয়।

রবীন্দ্র প্রতিভার আলোকস্পর্শ যখন ক্রমশ বিলীয়মান, যখন শরত্চন্দ্রের দিনও প্রায় শেষ পর্যায়ে, যখন দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে একটা অস্থিরতার স্পর্শ, এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে তারাশঙ্করের আবির্ভাব ঘটে বাংলা সাহিত্যে। তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোলে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া কালিকলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তার উপন্যাসে অসাধারণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নিজে জমিদারবংশের সন্তান হয়ে নিবিড়ভাবে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ, পুঁজিবাদও তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। একদিকে কৃষি অবকাঠামো ভাঙছে অন্যদিকে শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। কৃষক কর্মশূন্য হচ্ছে। একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহরজীবনের বিকাশ। সমাজের এই নীরব পরিবর্তন তার রচনায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে।

তাঁর রচনার বিষয় এবং রচনার চরিত্রগুলোর দিক থেকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। গ্রাম্যজীবনভিত্তিক নিম্নবিত্ত সমাজের ব্রাত্যজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনী, আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনী। একটা ভাগ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ পর্যন্ত। আর একটা ভাগ ‘মন্বন্তর’ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। ‘মন্বন্তর’ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’র আগে লিখিত হলেও ‘মন্বন্তর’ তার সাহিত্য জীবনের রূপান্তর সূচনা করে। একাধিক কালজয়ী উপন্যাস, গল্প লিখেছেন তিনি। তার ‘কবি’ উপন্যাসটির মূল বিষয় তৎকালীন হিন্দু সমাজের রূপ ও আচার, প্রেম, জীবনসংগ্রাম, মনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। মূলত একজন মানুষকে ঘিরেই উপন্যাসটি আবর্তিত। সে মানুষটি হলো নিতাই, নিতাইচরণ। নিতাই খুব নীচু বংশের সন্তান, পূর্ব পুরুষের পাপে সে অতিষ্ঠ। চোর, ডাকাত, খুনিদের বংশে জন্মেও সে চায় জন্মের চেয়ে কর্মকে বড় করে দেখতে। বিধাতার দেওয়া সুমিষ্ট কণ্ঠ দিয়ে সে জগেক জয় করতে চায়, চায় বংশের পাপ মোচন করতে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই বাধ্য হয়ে মাকে ছেড়ে, বাবার ভিটে ছেড়ে মুটের কাজ করতে হয় রেলস্টেশনে। রেলস্টেশনে সে পায় অকৃত্রিম বন্ধু রাজন, রাজাকে সে সত্যিই রাজা ধনে নয় মনে। নিতাই সুযোগ পেয়ে গ্রামের আসরে কবি গান গায় আর বনে যায় কবিয়াল, তাও সবার কাছে নয় রাজা, ঠাকুরঝি আরও পরিচিত সবার কাছে। তাই সে ব্রত নেয় যে করেই হোক তার কবিয়াল হওয়া চাই। কিন্তু এই স্বল্পশিক্ষিত আর নীচু বংশের মানুষের কীভাবে বড় কবিয়াল হওয়া সম্ভব? উপন্যাসটিতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত পরিবেশে তা সম্ভব। অনেক সাধনায় একজন সাধারণ নিতাইচরণ হয়ে ওঠেন একজন নামকরা কবিয়াল।

১৯৫৫ সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে তাসখন্দে এশিয় লেখক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তিনি সফর করেন মস্কোও। অর্থের প্রয়োজনে শেষদিকে কিছুদিন দৈনিক সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন। শেষ বয়সে কিছু ছবিও এঁকেছিলেন। তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। তার যেসব রচনা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে জলসাঘর ও অভিযান (১৯৬২), অগ্রদানী, আগুন, আরোগ্য নিকেতন, উত্তরায়ণ, কবি, কান্না, কালিন্দী, গণদেবতা, চাঁপাডাঙার বউ, জয়া, ডাকহরকরা, দুই পুরুষ, ধাত্রীদেবতা, ফরিয়াদ, বিচারক, বিপাশা, মঞ্জরী অপেরা, রাইকমল, শুকসারী, সন্দীপন পাঠশালা, সপ্তপদী, হার মানা হার, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, বেদেনী (২০১০) উল্লেখযোগ্য।

প্রায় ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী-মূলক বই ও ২টি ভ্রমণের বই রচনা করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তাঁর অন্যন্য গ্রন্থ ‘গণদেবতা’র জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পদ্মশ্রী ও ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও সাহিত্য আকাদেমি ও রবীন্দ্র পুরস্কারেও ভূষিত হন তিনি।

১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই, বীরভুমের লাভপুরে জন্মগ্রহণ করেন। চলে গিয়েছেন ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ আজকের দিনে।  লাভপুর ও লাল-মাটির বাংলা বারবারই তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। কলকাতা থেকে আমোদপুর স্টেশনে নেমে লাভপুরের বাড়িতে যেতেন তিনি। তারাশঙ্করের সময় লাভপুর নেহাতই অনামী গ্রাম ছিল। এই গ্রামেই তাঁর সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি। লাভপুর এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষ আর মানুষের সুখ-দুঃখের কথাই উঠে এসেছে তারাশঙ্করের সাহিত্যে। সেই হাঁসুলীবাঁক এখনও আছে। বয়ে যায় তেমনই কোপাই নদী। শুধু সেই বনোয়ারী – করালী এখন আর নেই। একদা জমিদারশাসিত লাভপুর এখন পঞ্চায়েতের অধীনে। সতীপীঠ ফুল্লরা আর লেখক তারাশঙ্করের ভিটের মাটি ছুঁতে এখনও প্রতিদিন লাভপুরে আসেন বহু পর্যটক।

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...