দেশের গর্ব,বাঙালির গর্ব তপন সিনহা

তাঁর সঙ্গে মহানায়কের অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। এই উত্তম কুমার উচ্চারণ ভালো করে দেওয়ার জন্য দ্বারস্থ হন তপন সিনহার কাছে তো কখনও তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন। তপন সিনহার ফিল্ম ক্যারিশমা কতটা তা দুটো ঘটনায় অনেকটা ধারণা তৈরি করে দেবে।

 

ঘটনা ১

উচ্চারণটা ভাল না,তার কাছে এমন অকপট স্বীকারোক্তি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তমকুমারের,তপন সিনহার দাওয়াই তিনি প্রতিদিন সন্ধাবেলা একটা করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃতি করেন,সেই পরামর্শ উপেক্ষা করেন নি বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তমকুমার৷

 

 ঘটনা ২

উত্তমকুমার বাঞ্ছারামের বাগানে অভিনয় করতে পারেননি। দ্বৈত চরিত্রে এসেছিলেন দীপংকর দে। উত্তমকুমার চেয়েছিলেন ছবির শুটিং মার্চে শুরু হোক। তার আগে ডেট দিতে পারবেন না। তপন সিনহা  রাজি হননি। উত্তমকুমার মামলাও করেছিলেন। আদালতের জিজ্ঞাসা ছিল: মিস্টার সিনহা, উত্তমকুমারের মতো শিল্পীর জন্যে আপনি কি তিনটে মাস ছবির কাজ বন্ধ রাখতে পারেন না? তপন সিনহার জবাব ছিল: ‘তিন মাস পরে উত্তমকুমারকে পাব, কিন্তু শীতের সরষেফুল? কোথায় পাব?’

 

tapan-uttam

 

প্রবাদপ্রতিম পরিচালক তপন সিনহা সিনেমা নিয়ে কাটিয়েছেন জীবনের প্রায় ষাট টি বসন্ত,

বাংলা হিন্দি সহ বিয়াল্লিশটি ছবি করেছেন অথচ সেই তালিকায় বানিজ্যিক ভাবে অসফল,এমন ছবি একটিও নেই৷

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই তপন সিনহা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক,যার নাম সত্যজিৎ রায়,মৃণাল সেন,ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়৷

সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসাধারণ সব ছবি পরিচালক তপন সিনহা আমাদের উপহার দিয়েছেন৷

 অভিনেতা রবি ঘোষের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল তপন সিনহার 'গল্প হলেও সত্যি'তে অভিনয়ের পর। ছবিতে এক চাকরের ভূমিকায় অসমান্য অভিনয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মূল চরিত্র।'এক ডক্টর কি মউত' ,পরিচালক তপন সিংহের আর এক অনবদ্য সৃষ্টি দর্শক,বিদগ্ধ মহল,চলচ্চিত্র সমালোচকরা মুক্তকণ্ঠে তাঁর প্রশংসা করেছেন,অথচ সিনেমা নির্মাণে তপন সিনহা কখনও কোনও সমঝোতা করেন নি,বরং তাঁর কৃতিত্বের বড় দিক কি? কেউ প্রশ্ন তুললে বলতে হবে প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের গল্প সেলুলয়েডে পর্দায় ধরে রেখেও অটুট রেখেছিলেন সাহিত্য রস, আবার সেই সিনেমা দেখে একইভাবে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক,সমালোচক৷ রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বনফুল, সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, শংকর,কে নেই সেই তালিকায়৷

tapan-soumitra

কাজের বিষয়ে বেশ খুঁতখুঁতে ছিলেন,ছোট একটা উদাহরণ 'ঝিন্দের বন্দি',পরিচালনা করার সময় তাঁর নির্দেশে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মত বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়েছিল ৷ সত্যজিৎ থেকে তপন সিনহা কোনও কঠিন চরিত্রর কথা ভেবেছেন, খোঁজ পড়েছে সৌমিত্রের, যিনি নিশ্চিতভাবে সর্বাধিক অভিব্যক্তিতে রক্তমাংস এনে দিতে পারতেন সেই চরিত্রে৷

 'হুইলচেয়ার', করার সময় সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে শুনতে হয়েছে অন্তত এক মাস হুইল চেয়ারে বসে ঘুরে বেড়ানো রপ্ত করতে হবে,এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ডাক্তারের চরিত্র তুলতে কয়েক মাস ধরে হুইল চেয়ারে চলাফেরা রপ্ত করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসালয়ে গিয়ে দিনের পর দিন লক্ষ করেছেন ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক, চিকিৎসকের মানসিক অবস্থার সূক্ষ্ম রকমফের৷ উত্তমকুমারের সঙ্গে অবশ্য সখ্য তাল কেটেছিল 'বাঞ্ছারামের বাগান' বাগান'ছবির শুটিংয়ের ডেট নিয়ে, ছবি করার কথা ছিল মহানায়কের,তবে ডেট নিয়ে সমস্যা,উত্তমকুমার কে তপন সিনহা বললেন তিনি বরং ছবিটা ছেড়ে দিন দীপঙ্কর দে আসলেন মহানায়কের জায়গায়, এসব নিয়ে মামলাও হয়েছিল৷

 

১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর বীরভূম জেলার মুরারই থানার জাজিগ্রামের সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তপন সিনহা , কারও কাছে তিনি আবার তপন সিনহা৷পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী,বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করার পর  ১৯৪৬ সালে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে সহকারী শব্দগ্রহণকারী হিসাবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন৷ প্রথম ছবি 'অঙ্কুশ',কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে তাঁর 'কাবুলিওয়ালা' রাতারাতি সিনেমাপ্রেমীদের মন জিতে নিয়েছিল৷

tapan-1

 

 

 এই ছবি নিয়ে আছে বেশ মজার কাহিনী৷ সবাই সেট লাইট প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত, হঠাৎ ছবি বিশ্বাস কাবুলিওয়ালার বেশে প্রবেশ করলেন। সবাই চমকে উঠলেন, অতি দরিদ্র মলিন বেশধারী হিং বিক্রেতা কোনও কাবুলিওয়ালা, না কি সদ্য কবর থেকে বেরিয়ে আসা স্বয়ং মহম্মদ বিন তুঘলক? মাথায় জরির পাগড়ি। গায়ে সিল্কের আচকানের ওপর জরির কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেট। পায়ে সোনার জরির কাজ করা নাগরা। এর আগে ছবি বিশ্বাস স্বয়ং ছবির পরিচালক কে বলেছেন তিনি যেন তাঁকে কাবলেদের সম্পর্কে একজন অথরিটি ভেবে নিতে পারেন, তাদের সাথে অনেক মেলামেশা করেছেন৷ছবি বিশ্বাস হলেন সে যুগের অজেয় দুর্দান্ত অভিনেতা কথা না বাড়িয়ে তপন সিনহা কাজ শুরু করলেও অসন্তোষ প্রকাশ করলেন প্রযোজক তিনি পরিস্কার বললেন ঔরঙ্গজেবের পোশাক ছেড়ে ছবিদাকে গরিব কাবুলিওয়ালা সাজতে হবে৷যেটুকু শুটিং হয়েছে সব যেন বাদ দেওয়া হয়৷ ছবি বিশ্বাস প্রযোজক-পরিচালকের যুক্তি মেনে নিলেন,নতুন করে পোশাক তৈরি হল,শুরু হল নতুন করে শুটিং৷ যাই হোক 'কাবুলিওয়ালা' শ্রেষ্ঠ জাতীয় ছবির পুরস্কার পায়,তেমন পেয়েছিল বাংলা ভাষায় সেরা ছবির শিরোপা,সপ্তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নেয় সিলভার বিয়ার এক্সট্রা অর্ডিনারি প্রাইজ অফ দ্য জুড়ি৷

 

 

কীভাবে শুরু হয়েছিল ফিল্মি কেরিয়ার?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতোকত্তর করার পর তপন সিনহা ১৯৪৬ সালে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে সহকারী শব্দগ্রহণকারী হিসাবে যোগ দেন। পরে ক্যালকাটা মুভিটোন স্টুডিয়োয় শব্দযন্ত্রী হিসাবে; তারও পরে লন্ডনের পাইনউড স্টুডিয়োয়। 'অঙ্কুশ' (১৯৫৪) ছবি দিয়ে কাজ শুরু। চতুর্থ ছবি 'কাবুলিওয়ালা' থেকে সর্বভারতীয় খ্যাতি। ক্রমশ বিশ্বপরিচিতি, দেশে ও বিদেশে বহু সম্মান ও পুরস্কার লাভ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গল্প  নিয়ে ১৯৫৭ সালে তপন সিংহ তৈরি করেন 'কাবুলিওয়ালা'। যেখানে ছোট্ট মেয়ে মিনির সঙ্গে ভাব হয়ে গেল দূর আফগান দেশ থেকে সওদা করতে আসা রহমত কাবুলিওয়ালার। ১৯৬৫ সালে তৈরি হয় 'অতিথি'। সেটাও কবিগুরুর লেখা গল্প। আপনভোলা ছেলে তারাপদর গল্প - যাকে মায়ের স্নেহ বা বন্ধুর ভালবাসা, কোন কিছুই বেশিদিন এক জায়গায় বেঁধে রাখতে পারেনা। তাই বাঁশীর সুরে, সব ভুলে,  দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায় তারাপদ।

tapan-2

১৯৭৪ সালে তপন সিনহা তৈরি করেন ছোটদের জন্য হিন্দি ছবি 'সফেদ হাতি' । এই ছবিটির গল্প তিনি নিজে লিখেছিলেন। গ্রামের ছোট্ট ছেলে শিবুর সাথে বন্ধুত্ব হয় জঙ্গলের হাতিদের রাজা, ধপধপে সাদা হাতি ঐরাবতের। ঐরাবত শিবুকে সোনার মোহরের সন্ধান দেয়। শিবুর কুটিল কাকিমা সব কিছু জানতে পেরে যায়। তারপর একদিন এক মহারাজা জঙ্গলে শিকার করতে এলে, লোভী কাকা কাকিমা তাকে গিয়ে সাদা হাতির কথা বলে দেয়। মহারাজা তখন শিবুকে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। তাই দেখে, বন্ধু ঐরাবত নিজের থেকে রাজার হাতে ধরা দেয়। ঐরাবতকে ধরা দিতে দেখে, শিবুর বন্ধু ময়না পাখি জঙ্গলের অন্য সব পশুপাখিদের ডেকে আনে। জঙ্গলের যত হাতি, বাঘ, সাপ আর পাখিরা মিলে, রাজা আর তার সঙ্গীদের ভয় দেখিয়ে ঐরাবতকে জঙ্গলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

 

ছোটদের জন্য তৈরি করা তাঁর অন্যান্য ছবিগুলি হল 'সবুজ দ্বীপের রাজা' (১৯৭৯),  'আজ কা রবিনহুড' (১৯৮৭/হিন্দী), 'আজব গাঁয়ের আজব কথা'(১৯৯৯) আর 'অনোখা মোতি (২০০০/হিন্দী), 'এক যে ছিল দেশ' (১৯৭৭)। এই ছবিতে এক তরুণ বৈজ্ঞানিক এমন এক ওষুধ আবিষ্কার করেন যে তার এক ফোঁটা পেটে গেলেই সবাই সত্যি কথা বলতে শুরু করবে। তার ফলে হল কি? -যত কালোবাজারি আর মিথ্যাবাদী নেতারা সব সত্যি কথা বলে ফেলতে শুরু করল আর বেঁধে গেল নানা গন্ডগোল। ১৯৬৬ সালের 'গল্প হলেও সত্যি' এইরকম আরেকটা মজার ছবি। এক বড়সড়  ঝগড়াটে পরিবারে, একদিন ভোরবেলা রাঁধুনি হয়ে এল এক অদ্ভুত মজার মানুষ। সে এমন এমন কান্ড ঘটাতে লাগল যে, সেই পরিবারের লোকজন সব ঝগড়া করতে ভুলে গেল!!

 

তপন সিনহার বেশিরভাগ ছবির মধ্যেই থাকত কোন না কোন সামাজিক ঘটনার দিকে আলোকপাত। তাঁর অনেক ছবির গল্পই কিন্তু জীবন থেকে নেওয়া সত্যি ঘটনার আদলে তৈরি।

tapan-3

 

শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সফলতা পরিচালক তপন সিনহার ইউএসপি ভাবলে ভুল হবে৷বরং  চলচ্চিত্র বোদ্ধারা তাঁর সিনেমা নির্মাণের মুন্সিয়ানা, শিল্পবোধকে সর্বদা সম্মান করেছেন,শ্রদ্ধা করেছেন৷ যিনি নিজে ৪২টি সফল ছবি পরিচালনা করেছেন তাকে কি এভাবে চেনানো যায়!নাকি সম্ভব! তপন সিনহা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার বিজয়ী পরিচালক,দেশের গর্ব,বাঙালির গর্ব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...