‘তিন ভুবনের পারে’ ছবির গম্ভীর প্রেমিকাকে মনে পড়ে? বা 'দেয়া-নেয়া' ছবির কলেজপড়ুয়া খামখেয়ালি, অভিমানী মেয়েটা? কিংবা 'রাজকুমারী' ছবির সেই প্রায়-পর্দাসীনা ভীতু রাজকন্যা?
বাঙালির কাছে তিনি হরিণী চোখের ছটফটে সুন্দরী। পর্দায় এলে যেন সমুদ্রের হাওয়ার ঢেউ লাগে মনে। নরম-সরম নায়িকা, কিন্তু আগুনে জেদটিও চাপা থাকা না পর্দায়। নাম তনুজা।
পুরো নাম তনুজা সমর্থ। মুম্বইয়ের এক মারাঠি পরিবারে জন্ম। বাবা-মা দুজনেই সিনেমার জগতের মানুষ। বাবা কুমারসেন সমর্থ ছিলেন কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক আর মা শোভনা সমর্থ চল্লিশের দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী।
পড়াশোনা তেমন ভাল লাগত না। বরং অপরূপ সুন্দরী মায়ের সাজ অনেক বেশি টানত ছোট্ট তনুজাকে। বাবা-মা'র দুনিয়াতেই একদিন পা রাখলেন।
বড় দিদি নূতনের সঙ্গে ১৯৫০ সালে ‘হামারি বেটি’ ছবি দিয়ে শুরু হল ছবি জীবন। শিশুশিল্পী হিসেবে। প্রথম চলচ্চিত্র অভিনয় করেন। এক দশক পর নায়িকার ভূমিকায় অভিষেক ঘটল। ‘ছবিলি’ ছবি দিয়ে। সেই ছবির পরিচালক ছিলেন তাঁর মা শোভনা সমর্থ।
ষাটের দশকে তনুজা কলকাতার বাংলা সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। প্রথম ছবিতেই বিপরীতে উত্তমকুমার। ১৯৬৭-তে ‘অ্যান্টনি-ফিরিঙ্গি’ । পর্দার 'সৌদামিনী' মনের মধ্যে ঘর বাঁধল দর্শকদের। হীরের দ্যুতির মতো ঝকঝকে স্ক্রিন প্রেজেন্স! যেন এক অন্য আবিষ্কার। কে বলবে তিনি মারাঠি কন্যা!
মা শোভনা সমর্থের সঙ্গে কলকাতায় থাকতেন। খুব খেটেখুটে বাংলা শিখেছিলেন। বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে যাতে সঙলাপ অন্যকে দিয়ে ডাবিঙ করাতে না হয়, নিজের কঠা নিজেই বলতে পারেন তাই এই সাধনা। ‘দেয়া-নেয়া’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘প্রথম কদম ফুল’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘লাল কুঠি’। বহু ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন তিনি।
উত্তমকুমার ছাড়াও তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে তিনি অত্যন্ত সফল। বিয়ে করেন সমু মুখোপাধ্যায়কে। তনুজা সমর্থ হন তনুজা মুখোপাধ্যায়।
হিন্দি ছবিতেও পাল্লা দিয়ে সফল। দীর্ঘ দিন পর্দার অন্তরালে থাকার পর বাংলা ছবিতে ফিরে এসেছিলেন সম্প্রতি। 'সোনার পাহাড়' ছবিতে আবার ফিরে পেয়েছিলেন দর্শকরা বাঙালির 'নন্দিনী'কে।
তনুজা আপন মর্জির মালিক। বহু বিখ্যাত পরিচালকের মতে, বাংলা থেকে হিন্দি বহু হিট ছবির নায়িকা কখনও নিজের কেরিয়ারকে খুব সিরিয়াসলি নেননি। অথচ তিনি জাত নায়িকা। দর্শকদের মন জিতেছিলেন হেলায়, কিন্তু ‘নাম্বার গেম’-এ কোনওদিনই বিশ্বাসী ছিলেন না।
জীবনকে শুরু থেকেই অন্যভাবে দেখে এসেছেন। এখনও নিজের জীবনকে নিজের বিশ্বাসেই সাজিয়েছেন। লাইম লাইটের চড়া আলোর বাইরে নিভৃত তাঁর জীবন, কিন্তু অন্তরালবাসিনী তিনি নন। মেয়েদের সঙ্গে জন্মদিন বা বেড়াতে যাওয়া সবই আছে। সেই সব মুহূর্ত দেখাও যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অতীত নিয়ে আবেগ আছে, কিন্তু তাঁকে টানে না। অতীতের স্মৃতি হাতড়ানো জীবন তাঁর পছন্দ নয়। বর্তমান ঠিক যেমন, তাকে সেভাবেই নিয়েছেন। তনুজা বলেন, “ অতীত কত ভাল ছিল-এভাবে আমি বলব না।আগে আমি কত ভাল ছিলাম সে নিয়ে কান্নাকাটিও নেই আমার। অবশ্যই ভালো স্মৃতি আনন্দ দেয়, কিন্তু আমার এখনকার জীবনটাও সুন্দর আর শান্তির…”
আজ সেই ভুবনমোহিনী সুন্দরীর জন্মদিন।