চেন্নাইয়ের বাসিন্দা তিনি। একটা সময়ে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সঠিক সময়ে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত, বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন।
সময়টা ১৯৯২। মুরুগান তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২৭ বছর পর এখন তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত, যাঁরা গৃহহীনদের দেখাশোনা সহ প্রতি সপ্তাহে তাদের ‘মিল’-এর ব্যবস্থা করে থাকেন।
ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে করতে তিনি বলছিলেন, “একশো ভাগ দেওয়া সত্ত্বেও পরিক্ষায় ফেল করেছিলাম আমি, এবং সে সময় বিষয়টা খুব ভালোভাবে নিই নি। পকেটে ৩০০ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, একটা অচেনা বাসে উঠে পড়েছিলাম আর ঠিক করেছিলাম বাসটা যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই আমি আমার জীবন শেষ করবো।“
বাসটি তাঁকে তাঁর নিজের শহর চেন্নাই থেকে প্রায় ৫০০ কিমি দূরে কোয়াম্বাটুরের সিরুমুগাইতে নিয়ে যায়। এই পুরো যাত্রাপথে একবারের জন্যেও তিনি তাঁর ব্যর্থতা নিয়ে ভাবেননি।
“রাত দুটোর সময় সিরুমুগাইয়ের এক ফুটপাতে বসেছিলাম। নিজেকে মূল্যহীন মনে হচ্ছিল। এক বৃদ্ধ মুচির সাথে আমার আলাপ হয়, তিনি আমাকে সেই রাতের জন্য আশ্রয় দেন। সে রাতে আমি আমার চারপাশে অনেক দুর্ভাগা মানুষকে ফুটপাতে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম।“ বলছেন ৪৫ বছরের মুরুগান।
এই রাতই অনন্য বাঁক নিয়ে আসে মুরুগানের জীবনে । চারপাশের প্রকৃত বাস্তব প্রত্যক্ষ্য করে সত্যের মুখোমুখি হন তিনি।
“হঠাৎ উপলব্ধি করলাম, জীবনটা এভাবে নষ্ট না করে দুর্ভাগা মানুষদের সেবায় তা নিয়োগ করা যায়। আর সে ক্ষেত্রে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটি ভয়ংকর বোকামি। সেই রাতের কথা কখনও ভুলতে পারবো না, অথবা সেই বৃদ্ধটি, যিনি আমার পরিচয় না জেনেই আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সিরুমুগাই বাস স্টপের সমস্ত ভিক্ষুখরা আমাকে চেন্নাই ফেরত পাঠানোর জন্য নিজেরা টাকা জমান, কিন্তু তা আমি ফিরিয়ে দিই এবং সেখানে থেকেই মহান কিছু করার উদ্দেশ্যে জীবন নিয়োগ করব, এই সিদ্ধান্ত নিই।“
আর চেন্নাই ফেরেন না মুরুগান। থেকে যান সেখানেই। কিন্তু সেখানে থাকলেই তো চলবে না, জীবন অতিবাহিত করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত টাকাপয়সা , দরকার একটি কাজের। কাজের সন্ধানে বেরিয়ে নিকটবর্তী এক হোটেলে বেয়ারার কাজ পান তিনি।
“ওখানে তিনবেলার খাবার পাওয়া যেত। সুতরাং আমি ওখানে থাকতে শুরু করলাম এবং কাজে মননিবেশ করলাম। পাশের এক পুকুরে স্নান ও বাহ্যাদি সেরে কাজে লেগে যেতাম। ছ’মাস আমি এটা করি। তারপর অন্য একটি কাজ পাই। সকালে খবরের কাগজ বিলি করার কাজ। বিভিন্ন কাজ আমার জীবনে এসেছে, সমস্তই আমি মাথা পেতে নিয়েছি।”
২০০৬ সালে, তিনি যে কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে বেশ কিছু বছর অটো চালাচ্ছেন তিনি।
“অটো চালিয়ে যা আয় করেছিলাম, তার একটা অংশ গৃহহীনদের অন্নসংস্থানের উদ্দেশ্যে ব্যয় করি।“ জানাচ্ছেন দুই সন্তানের পিতা মুরুগান।
অটো চালিয়ে গড়ে ৩০০০ টাকা আয় হতো। সেই টাকার একটি অংশ নিকটবর্তী এক স্কুলের ‘স্পেশাল চাইল্ড’দের জন্যে সবজি, চাল ও অন্যান্য খাবার রান্নার উদ্দেশ্যে খরচ হতো। বারবার পেশা পরিবর্তন করলেও, কখনই তিনি দুঃস্থদের সেবায় আত্মনিয়োগের কাজ ছাড়েননি। এবং তা হ্রাস পাওয়ার বদলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ৬ জন বন্ধু তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন, যাঁরা প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদা দিতে থাকেন। ২০০৮-এ ‘নিজহাল মাইয়াম’ নামে একটি সংগঠন প্রবর্তন করেন মুরুগান। যার অর্থ হলো- ‘গৃহহীনের আশ্রয়স্থল’।
এরপর ক্রমেই অনেকে সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেন। আর আজ এই সংস্থাটি প্রতি রবিবার ১৩০০ জনেরও বেশি মানুষকে নিজেদের হাতে বানানো ‘সাম্বার-রাইস’ খাওয়ায়।
“সোম থেকে শুক্র আমরা অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করি। খাবার বানিয়ে এবং সেই খাবার ২৫টি আশ্রয়স্থলে বিতরণের মধ্যে দিয়ে আমাদের সপ্তাহান্ত হয়। শনিবার থেকে এর প্রস্তুতি চলে, রবিবার বিতরণ। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানও এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত।“
কিন্তু যথেষ্ট অর্থ কি চাঁদা মারফত ওঠে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, “সাহায্য করার জন্য আমাদের বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছেন। আমার প্রাক্তন মালিক শাব্বির ইমানি, উনি ঈশ্বর প্রদত্ত। প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা দান করেন তিনি।“
তার এই উদ্যোগ আমাদের নতুন করে মানবতার পাঠ শেখায়। একটা রাতের অভিজ্ঞতা, যা বদলে দিয়েছিল তার জীবন। দুর্বোধ্য পরিস্থিতিতে যাঁরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, তাঁদের জন্য প্রকৃত উদাহরণ বছর ৪৫-এর মুরুগানের জীবন। আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়, জীবনকে কে কীভাবে দেখছেন তার উপরই নির্ভর করে সবটা। জীবনটাকে যদি কোনও মহান উদ্দেশ্যে, সৎকার্যে ব্যয় করা যা্য়, তাহলে তা অচিরেই আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে।
“আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই একটা বাঁকের প্রয়োজন হয়। যেখান থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, নিজেদের সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা রয়েছে, তার থেকেও আমরা অনেক বেশী মূল্যবান। শুধু নিজেদেরকে সেই স্রোতে ভেসে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে।“, বলে চলেন মানবতাবাদী মুরুগান।