শিলাইদহের কুঠিবাড়ি। ঠাকুর এস্টেটের জমিদারিতে দারোয়ান, লেঠেল কিছু কম ছিল না। স্থানীয় হিন্দু- মুসলমান প্রজা ছাড়াও বেশ কয়েকজন ছিল শিখ। বাকিদের থেকে তাদের মাইনেও ছিল বেশি।
শরণ সিং আর গণপৎ সিং বহু বছর ধরে কুঠিবাড়িতে বহাল।
দেশ পাঞ্জাব হলেও দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিল বাংলার জল হাওয়ায়। তাগড়াই চেহারা দেখলেই আন্দাজ করা যেত তাদের লাঠির তেজ।
গণপৎ সিং একদিন তার এক ভাই-বেরাদর কে নিয়ে এল জমিদার বাড়িতে। দেশে কাজের নানা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শিলাইদহে এসেছে ভাগ্য ফেরার আশায়।
গণপত সিং তার অবস্থা দেখে তাকে একেবারে হাজির করল একেবারেই তাদের ‘ছোট মাইজী’র কাছে।
মূলা সিং তার দুঃখ দুর্দশার কথা বলে জানালো, তাকে যেমন করেই হোক পালন করতেই হবে। নাহলে পরিবার নিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে। এ কথা শুনে মাইজী আর স্থির থাকতে পারলেন না। বহাল করলেন। সেই দিন থেকেই জমিদার বাড়িতে মাসিক পনেরো টাকা মাইনেতে কাজে লেগে গেল সে। যদিও ছোট মাইজী জানালেন মাহিনার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে বাবু।
ছোট মাইজীর নজর থাকত সকলের দিকে।কাজে বহাল হয়েও মলিন মুখে ঘুরে বেড়ায় মূলা সিং। চোখ এড়াল না কুঠি বাড়ির ছোটি মাইজীর। অন্য দারোয়ানদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, মূলা সিং মন খারাপের কারণ।
তারা জানাল, মূলা সিং-এর রোজ তিন সের আটা লাগে দু’বেলা খেতে। তার মাহিনার টাকা পালোয়ানী শরীর ধরে রাখতেই শেষ হয়ে যায়। দেশের বাড়িতে প্রায় কিছুই পাঠাতে পারে না।
ছোটী মাইজী কিছু বলতে পারলেন না। ঠাকুর এস্টেটের আইনকানুন ভারী কড়া। মূলা সিং এর নতুন চাকরী, মাস তিনেকও হয়নি। কী করে তার মাইনে বাড়ানোর কথা বলবেন!
তবে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ তিনি নন। উপায় বের করলেন। পরদিন ভোরবেলা থেকে তিন সের করে আটা পৌঁছে যেতে লাগল মূলা সিং- এর ঘরে।
মাইজীর খাস চাকর বিপিন নিজে হাতে পৌঁছে দিয়ে এল। মূলা সিং তো অবাক!
জমিদারবাবু শিলাইদহ থেকে ফিরতে কয়েকমাস পর মূলা সিং এর মাইনেও বেড়ে গেল। পনেরো থে একেবারে কুড়ি। তার তো আনন্দ ধরে না।
বিপিন তার ছোটমাকে বলল, মাইনে তো বেড়ে গেছে, এবার তাহলে আর আটা দেওয়ার দরকার কী’ সংসারের হেঁশেল থেকে বন্ধ হোক টাকা দেওয়া। রান্নার ঠাকুর থেকে শুরু করে সকলের একই কথা’
কিন্তু মন বদলানো গেল না তাঁর। মূলা সিং- এর আটার বরাদ্দ একই রইল। তার ছোটি মাইজী তাকে দেখতে পেলেই ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, “খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হচ্ছে না তো?”
কুঠি বাড়ির তৎকালীন জমিদারবাবুর নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ‘ছোটি মাইজী’ মৃণালিনী দেবী। বাকিদের ‘ছোটমা’।