কাঠ ফাটা গরমে ক্লান্ত। কান পেতে থাকা আকাশের গায়ে। কবে সে আসবে। গুরু গুরু শব্দে তার পায়ের ধ্বনি। জলভরা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগলেই উচাটন মন। টিপ টিপ জলের দাগে ভরে যায় ছাদ, মাটি, ফুটপাত। বদলে যায় বাতাসের গন্ধ। মেঘমল্লারের সুরে ভেসে বেড়ায় ঘরের আনাচে কানাচে। আর থাকেন রবি ঠাকুর। বাঙালির বর্ষার অনুষঙ্গ ‘গীতবিতান’।
ঋতুর ভাগ অনুযায়ী গীত বিতানে ১১৫টি বর্ষার গান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঋতু পর্যায়ের গান যত লিখেছেন তার মধ্যে বর্ষার গান সব চেয়ে বেশি।
বালক বয়স থেকেই বর্ষার প্রতি তাঁর টান। জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থের ‘বর্ষা ও শরৎ’ নিবন্ধে তাঁর বালক-বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছেন, ‘বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া তখনকার বর্ষার দিনগুলি। বাতাসের বেড়ো জলের ছাঁটে বারান্দা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারীবুড়ি কক্ষে একটি বড় ঝুড়িতে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকাপা ভাঙিয়া আসিতেছে আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় ছুটিয়া বেড়াইতেছি। আর মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি, দরমায় ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে; অপরাহ্নে ঘর ঘোর মেঘের স্তূপে স্তূপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে। দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি নামিয়া আসিল; থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ ডাকার শব্দ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের নখ দিয়া এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন্্ পাগলী ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিতেছে; বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙিয়া পড়িতে চায়; অন্ধকারে ভালো করিয়া বইরের অক্ষর দেখা যায় না- পণ্ডিত মশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন; বাইরের ঝড়-বাদলটার উপরেই ছুটাছুটি, মাতামাতির বরাত দিয়া বন্ধ ছুটিতে বেঞ্চির উপরে বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে মনটাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়া দৌড় করাইতেছি। আরো মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্য দিয়া ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে; একটু যেই ঘুম ভাঙিতেছে মনে মনে প্রার্থনা করিতেছি, সকালেও যেন বৃষ্টির বিরাম না হয় এবং বাহিরে গিয়া যেন দেখিতে পাই, আমাদের গলিতেই জল দাঁড়াইয়াছে এবং পুকুর ঘাটের একটি ধাপও আর জাগিয়া নাই।”
তরুণ বয়সে যখন তিনি শিলাইদহে পদ্মার বোটে তখন বর্ষার অন্য এক রূপ তিনি প্রত্যক্ষ করেন। সেই রূপ ভয়াল। ভীষণ। উন্মত্ত।
‘বিবিধ প্রসঙ্গে’র ‘বসন্ত ও বর্ষার’ নিবন্ধে এ দুই ঋতুর তুলনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
‘বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বর্ষা সংসারী, গৃহী।
কবি বর্ষার মঙ্গলময় দিকটির দিকে তাকিয়েই এই উক্তি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্তরের বর্ষা আসলে বিরহী প্রেমিক। বিরহী যক্ষের মতো সে ঘন ঘোর মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কবি লেখেন,
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘন ঘোর বরিষায়।
এমন মেঘস্বারে বাদল-ঝরঝরে
আপনহীন তমসায়।
জানলার পর্দা ভিজে যায় জোলো হাওয়ায়। সোঁদা গন্ধে অন্য ভুবনের টান। পুরাতন হৃদয় জেগে ওঠে ঘুম ভেঙে। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের রেণু ছড়িয়ে থাকে পথ জুড়ে। চপল কিশোরী লজ্জা পায়।
এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিনী
ওগো প্রিয়সুখ ভাগিনী।
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা।
সারা জীবন ধরে প্রকৃতির সাধনা করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শব্দে শব্দে ছুঁয়ে গিয়েছেন প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ। গীতবিতানের পাতা তাই শুষ্ক পাণ্ডুলিপি হয়ে থাকেনি। সেখানে গানে গানে মেঘ নামিয়েছেন কবি। নব ধারা জলে অবগাহন। মন ভিজে যায়। চোখও। বিরহী হিয়া বার বার মুক্তি খোঁজে সেখানেই।
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে
তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান।’