৪ আগস্ট থেকেই কবির চেতনা ক্রমশ আচ্ছন্নের দিকে। ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেল তাঁর দুই কিডনিই বিকল। পরদিন থেকে ধীরে ধীরে কবি চেতনা হারাতে শুরু করলেন। শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে চলেছে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এসে জানিয়ে দিয়েছেন, কবির পরিস্থিতি চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাতের বাইরে।
তখন শুধু স্যালাইন কাজ করছে। কবিকে ঘিরে থাকা মানুষরা মনে মনে তৈরি ঝড়ের জন্য।
রাত থেকে শুরু হল ব্রহ্ম সঙ্গীত। কবির নাড়ি ক্রমশ ক্ষীণ।
পূর্ব দিকে মাথা রেখে কবি শুয়ে আছেন। অচৈতন্য। রাখি পূর্ণিমার লগ্ন তখন শেষের পথে। কবিকে ঘিরে রেখেছেন পরিজনরা। কেউ পায়ে হাত দিয়ে বসে আছেন। কেউ উপনিষদের মন্ত্র পাঠ করছেন। কেউ তাঁর কানের কাছে উচ্চারন করে চলেছেন, শান্তম শিবম অদ্বৈতম...
কবি স্তব্ধ হলেন। ঘড়িতে তখন দুপুর ১২ টা ১০ মিনিট। মধ্যাহ্নের পরিশ্রান্ত আলোয় অস্তে গেলেন রবি। ২২ শ্রাবণ।১৩৪৮ সন।
কবির নশ্বর দেহ সাদা বেনারসী ধুতি-উত্তরীয় দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। চাদরখানা গলায়। কপালে শ্বেত চন্দনের তিলক, গলায় রজনীগন্ধার মালা। চারপাশে শ্বেত পদ্ম। ফুলের গন্ধে বিভোর চারপাশ। আশ্চর্য প্রশান্ত কবির মুখ। বেদনার চিহ্নমাত্র নেই। শান্ত। প্রশান্ত।
এর মধ্যে হঠাৎ একদল উন্মত্ত জনতা এসে ঘরের ছিটকিনি ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ল। কোনও রকমে তাদের বাইরে বের করে দেওয়া হল। কবির ঘরের দরজায় পাহারাদার। এদিকে জোড়াসাঁকোর উঠোন তখন মানুষের দখলে। বাইরে প্রবল চাপ। জনতা দেখতে চায় রবি ঠাকুর কে। উন্মাদ চিৎকার, কোলাহল তছনছ করে দিচ্ছে শোকের আবহ। পরিস্থিতি দেখে ভেঙে পড়েছেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ। কেউ কেউ তাঁকে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে। কিন্তু জোড়াসাঁকর বাইরে তখন যা পরিস্থিতি কেউ ভাবতেই পারল না। এই পরিস্থিতির মধ্যেই কবির শেষ যাত্রার আয়োজন চলতে লাগল।
হঠাৎ ৩ টে নাগাদ একদল জনতা যেন রাতারাতি দখল করে ঘর-দুয়ার।সমস্ত আয়োজন বিধ্বস্ত করে তারা দখল করে নিল কবির দেহ। জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, জয় বিশ্বকবির জয়- রবি ঠাকুরের নামে জয় ধ্বনি দিতে দিতে তারা বিপুল জনতার স্রোতে মিশে গেল। কলকাতার রাজপথ লোকে লোকারন্য। কবিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিমতলা ঘাট মহাশ্মশানে।
ভিড়ের চাপে রথীন্দ্রনাথ যেতে পারলেন না শ্মশানঘাট পর্যন্ত। গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে গিয়ে নৌকায় করে নিমতলা ঘাটে যখন পোঁছলেন তখন কবির নশ্বর দেহ দাহ হয়ে গিয়েছে।
মৃত্যুর আগে কবি নির্মলকুমারী মহলানবিশকে বলেছিলেন— “তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবির জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’ – এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়...।”
তথ্য ঋণঃ (বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহালানবিশ, গুরুদেব- রাণী চন্দ)