নলেন গুড় আর শীতের কলকাতা তাঁকে টানে

দীঘল চোখ। দীর্ঘ শরীর। তীক্ষ্ণ নাক। ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। লম্বা বেণীর অসীমাকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল অশোকের। বাঙালি বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ একবার পাকা হলে ফেলে রাখে না। ঝপ করে বিয়ে হয়ে গেল অসীমা আর অশোকের।

তারপর রাতারাতি সাগর পেরিয়ে পরভূমে। সংসার অনভিজ্ঞা, অপটু দুই তরুণ তরুণী আসতে আসতে চিনতে থাকে নিজেদের। অনেকদিন পর একবার নিজের শহরে ফিরে তারা আবিষ্কার করে এতগুলো বছর ধরে কীভাবে তারা প্রতিদিন প্রেমে পড়েছে একে অপরের, কোনওদিন আলাদা আয়োজনে বলতে হয়নি সেকথা, শুধু মুহূর্তে সঙ্গে মুহূর্ত মিলে গিয়েছে একই সুরের গানে। সেদিন ভিক্টোরিয়ার সামনে যেন সেই না বলা কথাই একে অপরের কাছে স্বীকার করে নেয় দুজনে।   

hpse_fullsize__1450727361_The Namesake - Tabu - 5

সাদামাটা প্রবাসী দম্পত্তি অসীমা আর অশোককে ভারী ভালোবেসেছিল দর্শকরা। ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখা কাহিনি নিয়ে মীরা নায়ারের ছবি ‘দ্য নেমসেক’।  অশোকের ভূমিকায় ইরফান খান, অসীমার ভূমিকায় তব্বু। সেই এই ছবির প্রাণভোমরা।

শুধু ‘দ্য নেমসেক’ নয়, নিজের কেরিয়ারে আরও বহু ছবির প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছিলেন তব্বু। আসল নাম তবসুম ফতেমা হাসমি।

মেইন স্ট্রিম থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা, মায় ইউরোপীয় প্রোডাকশনেও তিনি এক ইভাবে উজ্জ্বল। দু-দুবার সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় সম্মান পেয়েছেন, ফিল্মফেয়ারে ৬ বারের সেরা। ২০১১তে ‘সমালোচকদের বিচারে সেরা’ চারবার সেরা অভিনেত্রী হয়ে রেকর্ড করেছেন। এহেন তব্বুর অভিনয়ের খিদে কিন্তু এখনও সমুদ্র সমান। জটিল মনস্তাত্ত্বিক চরিত্রে অভিনয় করতে ভালোবাসেন। পর্দায় যতই ভিড় থাকুক দর্শকদের চোখ কাড়তে তিনি অব্যর্থ।  কান্নার দৃশ্যে অভিনয়ে তাঁকে কোনওদিন গ্লিসারিন ব্যবহার করতে হয়নি।

MV5BYmFjOWMxYWMtNTRjOS00Mzg0LTk0MTQtYzAxNTUxZDA0NjQ5XkEyXkFqcGdeQXVyNDAzNDk0MTQ@._V1_

মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। হায়দ্রাবাদে সেন্ট অ্যানস হাইস্কুলে পড়তেন। ১৯৮৩তে চলে আসেন মুম্বই। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে দু’বছর পড়ার পর বলিউডে কেরিয়ার শুরু করলেন। কিন্তু শুরুর পথটা খুব সহজ ছিল না তাঁর জন্য। প্রথম হিটের আগে কেরিয়ারে একটানা ফ্লপ ছবি।

বাড়িতে সিনেমার পরিবেশ আগে থেকেই ছিল। শাবানা আজমি সম্পর্কে মাসি। দিদি ফারহা নাজ, ততদিনে বলিউডে নায়িকার ভূমিকায় চেনা মুখ। বলিউডে নামী সিনেমাটোগ্রাফার বাবা আজমি মামা। তাই তব্বু যে সিনেমা জগৎকেই নিজের কেরিয়ার করবেন তাতে বাড়ির লোকজন খুব অবাক হয়নি।

হিন্দি, ইংরেজি ছাড়াও উর্দু ও তেলেগু ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ তব্বু দশ বছর বয়সে প্রথম ক্যামেরার সামনে আসেন। তার ঠিক চারবছরের মাথায় ডাক এলো দেব আনন্দের কাছ থেকে। তখন ‘হাম নজওয়ান’ ছবির পরিকল্পনা করছেন তিনি। পর্দায় দেব আনন্দের মেয়ে হলেন তব্বু। তব্বুর প্রথম নায়িকার ভূমিকায় পর্দায় আসা দক্ষিণী ছবি ‘কুলি নং ওয়ান’ দিয়ে। বিপরীতে দক্ষিণী স্টার ভেঙ্কটেশ।

বলিউডে প্রথম নায়িকার ভূমিকায় ‘প্রেম’ ছবি দিয়ে। বিপরীতে সঞ্জয় কাপুর। বনি কাপুরের প্রযোজিত সেই ছবির শেষ হতে সময় লাগে আট বছর! তব্বু লাইমলাইটে এলেন নব্বই দশকের মাঝামাঝি। ১৯৯৪তে রিলিজ হল ‘বিজয়পথ’, দর্শক আলাদা করে চিনতে শুরু করল তাঁকে। অজয় দেবগণ-তব্বু জুটি সে বছরের সেরা। ১৯৯৬-এর ‘সেরা নবাগতা অভিনেত্রী’র পুরস্কারও পেয়ে গেলেন তিনি। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাব্বুকে। মূল ধাররা বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করলেও জোর দিতেন চিত্রনাট্যের ওপর।  ‘মাচিস’ আর ‘চাঁদনি বার’ ছবির জন্য দু দফায় জাতীয় অভিনেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর কেরিয়ার জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সোনালী পালক। অস্তিত্ব থেকে অ্যা স্যুইটেবল বয় তাঁর সাফল্যে রোজ যোগ হচ্ছে নতুন নাম।  

অন স্ক্রিন তব্বু তুখোড় অভিনেত্রী। অভিনয় করেন হৃদয় দিয়ে। অফ স্ক্রিন তব্বুও হৃদয়বতী এক মানুষ। অন্যের উপকারে সামর্থ্য ছাপিয়ে উপকার করেন মানুষের আত্মীয়, বন্ধু থেকে কাজের দুনিয়ার লোকজনও তাঁকে এভাবেই চেনে। কেউ কেউ বলেন অজস্র ছবিতে অভিনয় করলেই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স তাঁর সারাজীবন-ই তলানীতে। তার কারণ অন্যের দরকারে নিজেকে উজাড় করতে তিনি খুব একটা ভাবেন না। শুটিং-এর প্রয়োজনে গোটা দুনিয়া ঘুরে বেড়ান, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ছুটি কাটাবার গন্তব্য সেই মুম্বই আর হায়দ্রাবাদ। বড়জোর মার্কিন দেশ।

তব্বুর ‘কলকাতা কানেকশন’ বেশ টানটান। গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’ আর মীরা নায়ারের ‘নেমসেক’-এই দুই ছবির সূত্রে সরাসরি তাঁর কলকাতা যোগ। যখন কলকাতা আসেন মিষ্টি দই, নলেন গুড় আর গন্ধরাজ লেবু মিস করেন না। বরফ বাক্সে সঙ্গে নিয়ে যান। পুরোদস্তুর নিরামিষাশী তব্বু জীবনে প্রথমবার মাছ খেয়েছিলেন ‘আবার অরণ্য’ ছবির শুটিং-এ। তারপর থেকে মাছ ভক্ত হয়ে যান। তবে বাইরে কোথাও তিনি মাছ খান না।

কলকাতার গলি তাঁর খুব প্রিয়। দুর্গাপুজোয় সুযোগ পেলে ঘুরিয়ে গেছেন শহরে। আবার অরণ্যে ছবির জন্য বাংলা শিখেছিলেন। সেই ছবির সেটে অনেক বন্ধু পেয়েছিলেন তিনি। সেই বন্ধুত্ব আজও তাঁর কলকাতায় ফেরার টান। হাওড়া স্টেশন থেকে ফুল মার্কেট সব কিছুই তাঁকে অন্য অভিজ্ঞতা দেয়। শীতের কলকাতা শব্দে, গন্ধে, বর্ণে তাঁকে বড়ো বেশি টানে। তাই ফিরে ফিরে আসতে চান প্রিয় শহরের কাছে।   

     

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...