সমস্ত যন্ত্র কিংবা কন্ঠে অধিষ্ঠিত সুর-স্বর লহরী কখনই সক্ষম নয় স্নায়ু ক্ষরণে, রক্ত রঞ্জনে অথবা মনের কব্জায়। কারণ নিমগ্নতা, অনুভব, সাধনা -এসবকিছু সকলে ধারণ করতে পারে না, যে সব যন্ত্রী অথবা যন্ত্র তা ধারণ করতে পারে সে সব প্রকৃতিই আলাদা; আলাদা করে চেনা-বোঝা-উপলব্ধির। ঝড়ের নাদ, সমুদ্রের মীড়, মেঘের অংশস্বর, পাখির সুরাঙ্গ -প্রকৃতির নানা শব্দ-ভাব-লয় অন্তঃস্থ করে, ধ্বনিকম্পাঙ্ক ধারণে, আরোহণ-অবরোহণের মূর্ছনায় সেই 'আলাদা করে চেনা-বোঝা-উপলব্ধির' ইন্দ্রজাল বুনেছিলেন সুরের জাদুকর- মিয়া তানসেন।
সুরের ব্যাকরণ আর একাগ্রতায় তিনি বুনে ফেলেছিলেন রাগ মিয়া কি মালহার, মিয়া কি তোড়ি, দরবারী কানাড়া, রাজেশ্বরী আরও কত শ্রুতি সৌরভ। ইতিহাসে তাঁকে ঘিরে অনেক গল্প রয়েছে, যা এখনও অনুরণিত হয়ে চলেছে। সুরের ভাবে সারাক্ষণ মজে থাকতেন এ বান্দা, যে কারণে তাঁর নিজের গড়া সুরে ধরা পড়ত বহুমুখী মেজাজ। কখনও তা রক্ষণশীল, কখনও মুক্ত-টলমলে, কখনও হিমানী আবার কখনও আগ্নেয়গিরি। এমনও কথিত আছে, তিনি নাকি গান শুনিয়ে সুস্থ করতে পারতেন দুরারোগ্য রোগীকে, বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ডাক্তারি পরিভাষা অনুযায়ী এক্ষেত্রে তাঁকে 'মিউজিক থেরাপিস্ট'ও বলা যেতে পারে। পশু পাখিদেরও আকৃষ্ট করতেন গানের ভাষায়, ঠিক যেমনটা পারতেন ভূতের রাজার বর পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত গুপী গায়েন। তিনি উচ্চাঙ্গ-ধ্রুপদ সঙ্গীতের কিংবদন্তী ধারক ও বাহক। শুধু তাই নয়, বানিয়েছিলেন বাদ্যযন্ত্র বীণা। শোনা যায়, তানসেনের রেওয়াজকক্ষে সাতটি সরস্বতীমূর্তি ছিল এবং তিনি যখন রেওয়াজে বসতেন, মনে হত মূর্তিগুলি থেকে প্রতিধ্বনি আসছে।
(তানসেনের প্রতিকৃতি)
আগেই বলেছি তাঁর তৈরী বিভিন্ন সুর ছিল বিভিন্ন 'মুড' এর, সময়ের; সব ক্ষেত্রেই তা মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার তা ঠিক, কিন্তু সবসময় তা মনোরঞ্জনের খোরাক এমনটা নয়, কখনও কখনও তার সুরের তীক্ষ্ণতা হৃদয়ে ছুরিকাঘাত করে, কখনও জলদগম্ভীর, গভীর। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী আর রবীন্দ্রনাথের এক মজার তথা মনোজ্ঞ কথাবার্তা উল্লেখ করব- ১৩২১ সালে 'সবুজপত্র'-এ প্রমথ চৌধুরী লিখছেন, "মেঠোসুর সকলেরই হৃদয়ে প্রবেশ করে, তানসেনের সুর করে না। তানসেন আপন মনে সুর তৈয়ারী করিয়াছেন, সকলের হৃদয়ে তাহা প্রবেশ করে কিনা তাহার জন্য কোন চিন্তাই করেন নাই। রবীন্দ্রবাবু বলিয়াছেন, 'তানসেন মেঠো-সুর তৈরি করিতে বসিবেন না। তাঁহার সৃষ্টি আনন্দের সৃষ্টি, সে যাহা তাহাই; আর-কোনো মৎলবে সে আর কিছু হইতে পারেই না।'
(ভারতীয় ডাকটিকিটে তানসেন)
'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ' ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে এই স্থানই দেওয়া হয়েছে তাঁকে। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ওস্তাদ মিয়া তানসেন সম্রাট আকবরের নবরত্নসভার সদস্য ছিলেন, একথাও আমরা জানি। সঙ্গীতজ্ঞ 'তানসেন' হয়ে ওঠার পথে বার বার পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর নাম। আনুমানিক ১৫০৬ খৃষ্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে জন্মগ্রহণ করে কবি মুকুন্দ পাণ্ডের সন্তান রামতনু পাণ্ডে। ছোটবেলা থেকেই পাখির ডাকের সঙ্গে নিজের গলা মেলাত রামতনু, ক্রমে বাড়তে থাকে তার সুরপ্রীতি। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ছিলেন বৃন্দাবনের তৎকালীন বিখ্যাত শিক্ষক হরিদাস স্বামী। চলতে থাকে রামতনুর সঙ্গীত শিক্ষা। শোনা যায় পরে সে এক মুসলমানীর প্রেমে পড়ে, তাকে বিয়ে করে। ধর্মান্তরিত হয়ে যুবক রামতনু হয়ে ওঠেন আতা আলী খাঁ। সঙ্গীতপ্রেমী আকবর তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার খবর পেয়ে ডেকে পাঠান তাঁর দরবারে, গান শুনে উচ্ছ্বসিত ও মুগ্ধ হয়ে তাঁর নবরত্ন সভায় স্থান দেন, সম্মানসূচক 'মিয়া তানসেন' উপাধি দেন।
(তানসেনের মেঘ মলহারে বৃষ্টি নেমেছে)
তানসেনের সময় হিন্দুস্তানী ধ্রুপদীসঙ্গীতের মধ্য এশিয়ান ও পার্শিয়ান প্রভাব ছিল। সুর সম্রাট মিয়া তানসেন হিন্দুস্তানী ধ্রুপদী ও রাগসঙ্গীতে স্বকীয়তা ও ভারতীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতে জন্ম দেন নতুন রাগ-রাগিনীর। বিভিন্ন তথ্য ও গ্রন্থ মতে, তানসেন ৩৬ টি রাগের স্রষ্টা। তার মধ্যে ১৬টি রাগ ছিল গোয়ালিওরের। আনুমানিক ১৫৮৯ সালে ৬ মে ৮৩ বছর বয়সে তানসেন মারা যান। আনুমানিক সাল অনুযায়ী আজ তাঁর ৪৩০ তম মৃত্যুবার্ষিকী। গোয়লিয়রে অবস্থিত সুফি সাধক মোহাম্মদ গাউসের মাজারের পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়, কথিত আছে তাঁর আশীর্বাদেই নাকি জন্ম হয়েছিল এই বিস্ময়কর সুর সাধকের। তাঁর স্মরণে প্রতিবছর ডিসেম্বরে তাঁর সমাধিস্থলে আয়োজিত হয় 'মিউজিক ফেস্টিভ্যাল', উপস্থিত হন দেশ-বিদেশের সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত অনুরাগীরা; গমগমে প্রসন্নতায় জেগে ওঠেন গানের গুণী- রামতনু ওরফে আতা আলী ওরফে মিয়া তানসেন।
(সমাধিস্থল)