মানুষের শরীরের মূল যোগকলা বা টিস্যু হলো রক্ত| আর এই রক্তের মূল উপাদান আবার হিমোগ্লোবিন| রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে যে রোগটি হয় তাকে বলা হয় অ্যানিমিয়া| অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর কোনো রোগ বলে মনে না হলেও রোগটির আক্রমন জীবনকে অতিষ্ট করে তুলতে যথেষ্ট| এই রোগ পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি আক্রান্ত করে থাকে| নারী ছাড়াও কিশোর বয়সের ছেলে মেয়েরাও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে| রক্তাল্পতাকে সাধারনভাবে একটি রোগ মনে হলেও এর কিন্তু নানা প্রকারভেদ রয়েছে| সেই প্রকারভেদ অনুযায়ী আবার অ্যানিমিয়ার লক্ষণ বদলে যেতে থাকে| বিশেষ কোনো রোগে আক্রান্ত না হলে একজন সুস্থ পুরুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হওয়া উচিত ১৩.৮ থেকে ১৭.২ গ্রাম/ডেসিলিটার| একজন সুস্থ স্বাভাবিক মহিলার ক্ষেত্রে এই মাত্রাটি থাকে সামান্য কম| তাদের ক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হওয়া উচিত ১২.১ থেকে ১৫.১ গ্রাম/ডেসিলিটার| এই পরিমানের থেকে যখনই শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যায় তখনই ধরা হয় সেই ব্যক্তি অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত|
শরীর তার নিজস্ব কার্যকারিতা দ্বারা প্রথম পর্যায়ের অ্যানিমিয়া নিজেই সারিয়ে নিতে সক্ষম| কিন্তু শরীর যখন হার মেনে নেয় তখনই শুরু হয় সমস্যা| রক্তাল্পতার জন্য শরীরে যেসব লক্ষণ ফুটে ওঠে সেগুলি হলো,
১) দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া| এমনকি সারাদিন কোনো কাজ না করলেও ক্লান্তি দূর না হওয়া অ্যানিমিয়ার মূল লক্ষণ| তাই সারাদিন শুয়ে বসে ঘুমিয়ে ওঠার পরেও যদি নিজেকে ক্লান্ত মনে হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন|
২) কাজের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি অনুভব না করাও অ্যানিমিয়ার লক্ষণ| সারাদিন পরিশ্রমের পর অন্য কাজের জন্য শক্তি অনুভব না করাটাই স্বাভাবিক| কিন্তু ধরুন সারাদিন তেমন পরিশ্রমের কোনো কাজ করলেন না তাও যদি কোনো কাজে পর্যাপ্ত শক্তি অনুভূত না হয় তাহলে বুঝে নেবেন রক্ত পরীক্ষা করানোর সময় এসে গেছে|
৩) শরীরে অ্যানিমিয়া বাসা বাঁধলে সামান্য ব্যায়ামের পরেই বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে| তার সাথেই নিঃশ্বাসে কষ্ট এবং মাথার যন্ত্রণা হতে থাকে| সামান্য ব্যায়াম শরীরের পক্ষে ভালো| তাই অনেক মানুষই আছেন যারা দিনের কোনো না কোনো সময়ে ব্যায়াম করেই থাকেন| এরকম অভ্যেস যদি আপনারও থাকে কিন্তু হঠাত ব্যায়ামের পর উপরোক্ত লক্ষণগুলি দেখতে পান তাহলে একবার চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ|
৪) এছাড়াও মনোযোগের অভাব, সারাদিন দুর্বলতা অনুভব করাও কিন্তু অ্যানিমিয়ারই লক্ষণ| সারাদিন বাড়িতে শুয়ে থাকার পরেও সন্ধ্যেবেলা কাজ করতে অনীহা, বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে না করা, অল্প পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে যাওয়া প্রভৃতিও রক্তাল্পতার ফলাফল|
৫) ত্বক অত্যধিক সাদাটে হয়ে যাওয়া| অনেকসময় অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত নারীরা মনে করেন তারা হয়তো একটু ফর্সা হয়ে গেছেন কিন্তু এটিই সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা| তাই যখনই দেখবেন ত্বক আগের থেকে একটু বেশি সাদাটে লাগছে এবং অবশ্যই তা যদি ফেসিয়াল না করা সত্তেও হয় তাহলে অবশ্যই একবার রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমান পরীক্ষা করে নিন|
৬) হিমোগ্লোবিনের মূল উপাদান হল আয়রন| তাই শরীরে আয়রনের অভাব ঘটলে অ্যানিমিয়া হতে পারে| আর এর ফলস্বরূপ চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যায়|
৭) রক্তাল্পতার কারণে পায়ে ক্র্যাম্প, খিদে চলে যাওয়া, অনিদ্রা প্রভৃতিও হতে পারে|
আয়রনের ঘাটতি থেকে যদি অ্যানিমিয়া হয়ে থাকে তাহলে বিশেষ কিছু লক্ষণ প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয় তা হলো-
১) যাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি হয় তারা অদ্ভূত কিছু জিনিস খেতে চায়| যেমন ধরুন, কাগজ, বরফ, ধুলো প্রভৃতি| চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘পিকা’|
২) আয়রনের অভাবে নখ উল্টো দিকে কার্ভ হতে থাকে|
৩) আয়রনের অভাবে যদি শরীরে অ্যানিমিয়া বাসা বাঁধে তাহলে মুখে ঘা হওয়া থেকে শুরু করে ড্রাই মাউথ প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে থাকে| এর ফলে হাঁ করার সময় ঠোঁটের কোনা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায়|
ভিটামিন বি২ ডেফিসিয়েন্সি থেকে অ্যানিমিয়া হলে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হলো-
১) হাতে ও পায়ের পাতায় সূচ ফোটার অনুভুতি,
২) কেউ টাচ করলেও তা অনুভব না করতে পারা,
৩) পা ফুলে যাওয়া এবং হাটতে অসুবিধা অনুভব করা,
৪) হাতে ও পায়ে অস্বাভাবিক স্টিফনেস অনুভূত হওয়া|
লেডের বিষক্রিয়া থেকেও অ্যানিমিয়া হতে পারে| সেই ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো,
১) মাড়িতে একধরনের নিল বা কালো দাগ দেখা যায় এই রোগে যাকে চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় লেড লাইন বলা হয়ে থাকে|
২) এর সাথে পেটে ব্যথা, বমি, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রভৃতি এই রোগের আক্রমনের ফলে হয়ে থাকে|
অ্যানিমিয়া যেমন নানা প্রকারের হয় সেরকমই আলাদা আলাদা রকমের অ্যানিমিয়ার জন্য আলাদা আলাদা ট্রিটমেন্ট থাকে| তাই জীবনের কোনো পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যদি উপরোক্ত লক্ষণগুলি দেখতে পান তাহলে নিজে থেকে কোনো আয়রন সাপ্লিমেন্ট কিনে খাবেন না| সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই ওষুধ খাবেন|