আজ আলাপ হবে মিষ্টি পরিবারের এক সুন্দরী সদস্য ‘নকশি পিঠের’ সাথে। নকশি কাঁথার মতো বাহারি নকশা করা হয় বলে এ পিঠেকে নকশি পিঠে বলা হয়। যদিও পাকোয়ান, পক্কন বা ফুল পিঠে ইত্যাদি একাধিক নামে তার পরিচিতি। নকশা তার সৌন্দর্য্যের রহস্য হলেও স্বাদ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলি তার সৃষ্টিকাল সম্পর্কে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু সিগনেচার পিঠে আছে। তেমনি ঢাকার গাজীপুর বিখ্যাত তার এই সিগনেচার পিঠের জন্য। গাজীপুরেই সর্বপ্রথম নকশি পিঠের প্রচলন শুরু হয়। গাজীপুরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের মহিলারাই এ কাজে বেশ দক্ষ। ব্রত অনুষ্ঠানের উপজাত হলেও এই পিঠের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেহাত কম নয়, জানা যায় নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে মুসলিম নারীদের হাতেই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল এই নকশি পিঠের।
কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার নিজস্ব সম্পদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে সে, যদিও এর পিছনেও আছে এক কারণ। কৃষিপ্রধান বাংলার রীতি ছিল ভাদ্র-আশ্বিন কিংবা অগ্রহায়ন-পৌষ মাসে আউশ ও আমন ধান প্রথম কৃষকের ঘরে উঠলে নতুন ধানের চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হতো মূলত নকশি পিঠে, সেই ধারা আজও অব্যাহত। এছাড়াও বিয়ে-শাদি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঈদ, খাতনা, নবান্ন, শবেবারাত, শবেকদর ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে নকশি পিঠে বিশেষ প্রাধান্যের অধিকারী।
যাইহোক, এই নকশি পিঠের নামের বাহার কিছু কম নয়। গাজীপুর ছাড়া নোয়াখালী, ফেনী, মানিকগঞ্জ, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে পাকোয়ান নামে, কুমিল্লায় ‘খান্দেশা, রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চলে ‘ফুলপিঠে’ নামেও পরিচিত সে। তবে নকশার পার্থক্যেই নামের বাহার ঘটেছে, যেমন গোলাপ বাহার, গেন্দা বাহার, পদ্ম বাহার, ঝিলিমিলি, কড়িকোমল, কইন্যাবরণ, কইন্যামুখি, জামাইমুখি, জামাইসুখ, জামাই মুছরা, জামাই ভুলানি, মইফুলি, ডালিম দানা, মোরগ ঝুঁটি, জামদানি, ইত্যাদি। নকশি পিঠের সৌন্দর্য মূলত প্রস্তুতকারীর শিল্পবোধে, সে যা চায় সে নকশাই ফুটিয়ে তুলতে পারে।
এবার আসি পদ্ধতিতে। এই পিঠের বৈশিষ্ঠ্য হল যতদিন ইচ্ছে রেখে খাওয়া যায়, নষ্ট হওয়ার প্রবণতা কম। এর মূল অনুপান আতপ চালের গুঁড়ো, খেজুর কাঁটা ও তেল। প্রথমে লবন জলে আতপ চালের গুঁড়ো ভাল করে সেদ্ধ করে ময়দা মাখার মতো একটু মেখে মণ্ড তৈরি করা হয়। এই মণ্ড থেকে লেচি কেটে হালকা তেল দিয়ে বেলে মোটা রুটির মতো তৈরি করে, একটা পলিথিনের উপর সেই রুটির মতো গোল রেখে খেজুর কাঁটায় তেল দিয়ে তার মাধ্যমে নকশা করা হয়।
পলিথিন দেওয়ার কারণ যাতে নকশা করার সময় এই রুটির মতো গোলটিকে নড়ানো যায় এবং সেটি চাকির উপর লেগে না যায়। অবশ্য হাতের বদলে ছাঁচ দিয়ে নকশা আঁকা হয়। ছাঁচগুলো সাধারণত মাটি, পাথর, কাঠ বা ধাতু দিয়ে তৈরি হয়। এসব ছাঁচের ভেতর দিকে নকশা আঁকা থাকে। নকশা হয়ে গেলে ডুবো তেলে ভাজলেই তৈরী নকশি পিঠে। এবার চিনির রসে ডুবিয়ে বা দুধ ঘন করে তার মধ্যে ডুবিয়েও খাওয়া যায়। আবার ওই ভাজা পিঠে বেশ কিছুদিন রেখেও খাওয়া যায়।
এই নকশি পিঠে গ্রাম বাংলার নিজস্ব সম্পদ। পিৎজা, বার্গারের রাজত্বে এখনও কিন্তু এই পিঠে তার ঐতিহ্য দিব্যি বহাল রেখেছে। ওপার বাংলায় এর প্রচলন বেশি হলেও এপারের হেঁশেলেও তার সন্ধান মিলবে। চাইলে একবার বানিয়ে চেখে দেখতেই পারেন সুন্দরী নকশি পিঠে। কারণ এই সাবেকি মিষ্টির সন্ধান আপাতত অনলাইনের হাতের বাইরে।