বাংলার  বিখ্যাত চাউনি সন্দেশ

বলছি এ বাংলার এক অতি জনপ্রিয় মিষ্টি  চাউনি সন্দেশের কথা। অচেনা লাগছে? মনে হচ্ছে তো যে, 'যে নাম শোনেন নি তার আবার জনপ্রিয়তা?'  বেশ! কিন্তু যদি বলি মনোহরা! তাহলে? আজ এই ২০০ বছর বয়সী মিষ্টির কথাই বলব।
                               
হুগলীর জনাই ও মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার মনোহরার খ্যাতি অজানা নয়। শক্ত চিনির আবরনে কামড় দিলেই ছানা, চিনি, সর, ডাবের কচি শাঁস ও ক্ষীরের মিশেলে মুখের মধ্যে এক অবর্ণনীয় নৈস্বর্গিক আমেজ তৈরী  হয়। কিন্তু এই অবর্ণনীয় স্বাদের জন্ম ঠিক  কবে হয়েছিল সে প্রসঙ্গে অন্ততঃ গোটা ছয়েক  মত প্রচলিত হলেও জনপ্রিয় গোটা তিনেক মত। সেই কথাই আগে বলি।
                                 
জনশ্রুতি আছে, প্রায় ২০০ বছর আগে (ব্রিটিশ আমলে) এক সাহেব কলকাতা থেকে জনাই বেড়াতে যান। তখন জনাইয়ের ষষ্ঠীতলায় বসবাস করত প্রখ্যাত ময়রা ভীম নাগের বংশের একটি শাখা। সাহেব সেই ময়রাদের এমন এক মিষ্টি তৈরী করতে বলেন যা দিন পাঁচেক পরেও থাকবে সুস্বাদু।

তখন ফ্রিজ না থাকায় এমন মিষ্টি তৈরী নিয়ে তারা বেশ চিন্তায় পড়েন। যাইহোক, নাগ পরিবারের সদস্যরা বুদ্ধি খাটিয়ে মূল মিষ্টির উপর পুরু চিনির আস্তরণ তৈরী করেন যাতে তা নষ্ট না হয় এবং মিষ্টিটি অনায়াসে তিন থেকে পাঁচ দিন রেখে দেওয়া যায়। সেই যাত্রা মনোহরার।

misti-body
                              
দ্বিতীয় মতে, মনোহরার আবিষ্কারক ভীমচন্দ্র নাগের পিতা পরাণচন্দ্র নাগ। তিনি এক সময় ছিলেন বর্ধমান রাজের দেওয়ান। পরে চাকরী ছেড়ে জনাইতে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। এই সময়েই তার হাত ধরেই মনোহরার অভ্যুত্থান ঘটে। অন্য মতে, জনাইয়ের জনৈক ললিত ময়রা ১৮৬০-এ মনোহরা উদ্ভাবন করেন।
                       
  বেলডাঙার মনোহরার উৎপত্তি সম্পর্কেও একাধিক মত প্রচলিত আছে। একটি মত অনুসারে, মুর্শিদাবাদের নবাবদের খাস ময়রা থাকতেন কিরীটকোনা গ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দিরের কাছে। সেখানেই তিনি অষ্টাদশ শতকে প্রথম মনোহরা প্রস্তুত করেন।

মুর্শিদাবাদের নবাবরা ডাবের শাঁস, কাজুবাদাম, এলাচ ও ক্ষীর দিয়ে তৈরী মনোহরা পছন্দ করতেন। কালের নিরিখেই নবাবীর পতনের সাথে মনোহরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু জনাইয়ের মনোহরার চাহিদায় ভাটা পড়েনি।  
                             
এবার আসি স্বাদের বিশেষত্বে। জনাইয়ের মনোহরার মূল উপকরণ - ছানা, চিনি, পেস্তা, এলাচ ও দুধ। আগে মনোহরা তৈরি করতে নারকেল ব্যবহার হলেও এখন আর হয় না। কিন্তু ডাবের শাঁস ব্যবহার করা হয়। ছানার সাথে মিহি করা চিনি ও ছোট এলাচ মিশিয়ে আগুনে জ্বাল দেওয়া হয়। লক্ষ্য রাখা হয় যাতে মিশ্রণটিতে দানা ভাবটি থাকে।

মিশ্রণটা ক্রমশঃ গাঢ় হয়ে মাখা সন্দেশের মত হলে ঠান্ডা করে মন্ড প্রস্তুত করা হয়। এরপর মন্ড থেকে গোল্লা পাকিয়ে পেস্তা ও এলাচের গুঁড়ো মাখানো হয়। অন্যদিকে ঘন চিনির রস জ্বাল দিয়ে একটি করে গোল্লা সেই রসে ডুবিয়েই তুলে রাখা হয় কলাপাতার উপর। মিনিট চারেকের মধ্যে ঘন চিনির রসের প্রলেপটি শুকিয়ে একটি শক্ত আস্তরণে পরিণত হলেই তৈরী বিখ্যাত  মনোহরা।
                                        
জনাই রোডে আজও ললিত ময়রার দোকানের বিখ্যাত মনোহরা কিনতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় করেন। ললিত ময়রার পরবর্তী তিন পুরুষও মনোহরা বিক্রি করে চলেছেন আজও। বর্তমানে মনোহরা বিক্রি হয় জনাইয়ের প্রায় সমস্ত মিষ্টির দোকানেই। দিন-দিন চাহিদা বেড়েই চলেছে।

এখন অবশ্য কলকাতার বেশ কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও খোদ জনাইয়ের মনোহরার স্বাদ পেতে ৩৬৫অরেঞ্জেস.কমের শরণাপন্ন হতেই পারেন। তাদের মাধ্যমেই এখন নতুন করে এই মিষ্টি দেশ-বিদেশের খাদ্যরসিকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কেজি প্রতি মনোহরার দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা৷ তবে গুনতিতেও বিক্রি হয়৷ যাইহোক, খোদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রিয় এই ঐতিহ্যবাহী প্রবীণ মিষ্টির স্বাদ নিতে একবার চেখে দেখতেই পারেন...  মন হরণ হতে বাধ্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...